খবরটা পেলাম হঠাৎ করেই ফেসবুক এর মাধ্যমে। কেউ কেউ বলেন ফেসবুক জিনিসটা খুব খারাপ। সেটা হয়তো ঠিকই। তবে কিছু কিছু ভালো বা খারাপ খবর তো পেয়ে যাওয়া যায় এই ভাবেই এই মাধ্যমে হঠাৎ করেই। পি এইচ ইর সেই হাসি মুখের সেই প্রধান সচিব সৌরভ দাস আর নেই। আসলে কিছু কিছু অফিসার এর নানা কাজ এই ভাবেই মনে থেকে যায় আমাদের নানা ভাবে নানা সময়ে।
সেই নব মহাকরণের নয় তলার ঘরে বসে আছেন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় একা একাই। সন্ধ্যা বেলার একটু আগে আমি আর জটাশঙ্কর লাহিড়ী হাজির সুব্রত দার ঘরে। তখন ইটিভির বাংলার অস্থায়ী দায়িত্ব নিয়ে
জটাশঙ্কর লাহিড়ী কলকাতায় কর্মরত। আমরা দুজনে হাজির হয়েছি সুব্রতদার সাথে দেখা করতে। যদি কিছু খবর মেলে মন্ত্রীর কাছ থেকে এই আশায়।
আর তখন সুব্রতদার মুখে একটাই কথা গ্রামে গ্রামে খাবার জল পৌঁছে দিতে শুরু করবে তার দফতর আর কিছুদিনের মধ্যেই। যে পানীয় জল এর খুব দরকার গ্রামের মানুষের। না, হলে যে খুব সমস্যা তাদের। এটি খুব দরকার যে। আর এই বলেই বেল টিপে ডাকতেন তিনি তাঁর সচিবকে। আর দরজা ঠেলে হাসি মুখে হাফ শার্ট পরে হাতে ফাইল নিয়ে মন্ত্রীর ঘরে হাজির হতেন সচিব সৌরভ দাস । মন্ত্রীর কাছে সমস্ত তথ্য পেশ করতেন তিনি। জল সরবরাহের কাজ কি ভাবে হচ্ছে সেটা বুঝিয়ে দিতেন মন্ত্রীকে। কি তাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সেটা ব্যাখ্যা করে বলতেন। শুকনো জেলা বাঁকুড়া কি করে জল পাবে। বীরভূমের গ্রামে গ্রামে জল মিলবে কি করে। এইসব নিয়েই চিন্তা ছিল মন্ত্রী আর তাঁর সচিবের।
আর মন্ত্রী সব তাঁর সচিবের কাছ থেকে শুনে নিয়ে আমাদের তাঁর দফতরের কাজের কথা বলতেন, বাইট দিতেন হাসতে হাসতে। জানাতেন সেই জাইকার কাছ থেকে কিভাবে অর্থ বরাদ্দ করে তাঁর দফতর গ্রামে গ্রামে এই জল সরবরাহের কাজ শুরু করেছে ইতিমধ্যে। যা কিছুদিনের মধ্যে একটা বড় কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করবে গোটা রাজ্য জুড়ে। যে কাজের মূল হোতা ছিলেন এই প্রাক্তন সচিব সৌরভ দাস। যিনি পড়ে স্টেট ইলেকশন কমিশনার হয়েছিলেন। কাজ করেছেন পঞ্চায়েত দফতরেও।
বেশ মিষ্ট ভাষী, আলাপী, হাসিখুশি, কাজের মানুষ এই আই এ এস অফিসারকে তাঁর বর্ম ভেদ করে কিন্তু কোনোদিন রিপোর্টারদের তাঁর কাছে পৌঁছতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। সে জনস্বাস্হ্য কারিগরী দফতর হোক বা পঞ্চায়েত দফতর বা স্টেট ইলেকশন এর কমিশনার। সমস্ত জায়গায় এই ঠাণ্ডা মাথার মানুষটি বেশ কঠিন পরিস্থিতিকে হাসিমুখে সামলে দিয়েছেন সব কাজ। আর এটাই ছিল তাঁর সব থেকে বড় গুণ। যে কোনো কঠিন কাজেও কেমন সহজ করে তিনি করে ফেলতেন । কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতেন না তিনি। একটু যেনো নিজের ঢাক কম পেটানো একজন মানুষ। কিন্তু কোন রিপোর্টার এর বাড়ির কার শরীর খারাপ। কে কেমন আছে সেই সব খবর নিতেন তিনি একদম ঘরের মানুষের মতোই। যেটা তাঁর একটা বড় গুণ ছিল।
আর সেই নব মহাকরণের ঘরে বসে যেখানে এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক সুব্রত দা বলতেন, ভালই লাগে এই অফিসের ঘরে বসে বেশ সুন্দর গঙ্গার দৃশ্য উপভোগ করা যায় সন্ধ্যা হলেই। বলে হাঁটতে হাঁটতে জানলার ধারে চলে যেতেন তিনি। পিছন পিছন আমি আর জটা দা দাঁড়াতাম তাঁর পাশে। বুঝতাম এটা কিছুটা তাঁর অভিমানের কথাই। তারপর সাতটার পর বেনু দা বোধহয় নামটা আর সচিব সৌরভ বাবু বেরিয়ে যেতেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায় বাড়ী ফিরতেন মন্ত্রীর গাড়ি করে। আমরাও মন্ত্রীর সাথে অফিস ফিরতাম সেদিনের খবর সংগ্রহ করে।
কিন্তু সেই দ্বীপান্তর বাস ছেড়ে সুব্রত মুখোপাধ্যায় একদিন মহাকরণে ঘর পেলেন । গ্রামে গ্রামে জল পৌঁছে দেওয়া, আর ত্রিস্তর পঞ্চায়েত এর দায়িত্ব পেয়ে সুব্রত দার ঘরে তখন উপচে পড়ছে ভীড়। ঘন ঘন ফাইল হাতে সৌরভ বাবুর মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করা। বিকেল হলেই মহাকরণে সেই দোতলায় সুব্রতদার ঘরে তখন আবার সাংবাদিকদের ভীড় জমছে বেশ। কি খবর দেন তিনি তার জন্য। আর সেই সময় মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এর ছায়াসঙ্গী হয়ে কাজ করতেন এই সচিব সৌরভ দাস। পঞ্চায়েত আর জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কাজ করে গ্রামের মানুষের কাছে জল পৌঁছে দেবার কাজটা প্রথম শুরু করেছিলেন সেই সময়েই। কিন্তু একদম হুটার না বাজিয়ে যেমন রাস্তায় ঘুরতে পছন্দ করতেন তিনি। ঠিক তেমনি চুপচাপ কাজ করতেন তিনি।
আজ যে জল জীবন মিশনের কাজ চলছে গোটা রাজ্যে জুড়ে। যে জলের কাজ নিয়ে এত হৈ চৈ হচ্ছে দিকে দিকে। মুখ্যমন্ত্রীর এত বৈঠক করে সতর্ক করা চলছে প্রতি সপ্তাহে। সেই গোটা কাজটাই শুরু হয়েছিল এই সেই সৌরভ দাস এর আমলে। যাঁর হাত দিয়ে এই কাজ হয় সেই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় আজ আর নেই। তাঁর পছন্দের সচিব সঙ্গী সৌরভ দাস আজ চলে গেলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন, তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন। কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যানও ছিলেন। মাত্র ছেষট্টি বছর বয়সে এই হাসিখুশি মানুষটি চলে গেলেন। ভালো থাকবেন আপনি সৌরভ বাবু।
ভালো থাকবেন সৌরভ বাবু - অভিজিৎ বসু।
পনেরো ডিসেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য গুগল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন