ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে পড়েছে এমনটা কিন্তু একেবারেই নয়। আর সেই শীতের সন্ধ্যায় হাতে গরম ভাপা পিঠার পসরা সাজিয়ে বসে থাকা। সেই রাস্তার পাশে ভাপা পিঠের দোকান দেখে থমকে দাঁড়ালাম আমি। কলা ভবনের উল্টো দিকে ভ্যানের উপর উনুন বসিয়ে রাস্তার পাশে গ্যাস সংযোগ এর সিলিন্ডার রেখে হাঁড়ির ওপর গরম জলের হাঁড়ি রেখে টপটপ করে একের পর এক পিঠা বানিয়ে চলেছে ওরা তিনজন। মা, বাবা আর মেয়ে। দ্রুত হাতে কাজ করছে ওরা তিনজন। আর নন্দন মেলা থেকে বের হয়ে অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়ছেন এই গরম ভাপা পিঠার ভ্রাম্যমাণ দোকানের সামনে।
ভেজা ঘাসের ওপর বসে চালনি নিয়ে একমনে চাল গুঁড়োর মিহি করার কাজ করে চলেছেন তিনি অতি যত্নে আর পরম মমতায়। একমনে মাথা নিচু করে সেই কাজ করে চলেছেন তিনি। পরনে সস্তার ছাপা শাড়ি। গায়ে হাল্কা একটা চাদর পড়ে থাকা। ভীড় দেখে জিজ্ঞাসা করলাম কতজনের পরে। ঘাড় তুলে সেই মহিলা বললেন, একটু অপেক্ষা করুন না হয়ে যাবে। অন্য দিকে বাবাকে সাহায্য করছে মেয়ে কোনো কথা না বলেই। শক্ত গুড়কে ছুরি দিয়ে কেটে বাবাকে সাহায্য করছে বছর পনেরোর একটি মেয়ে। আর কোনরকমে গরম গরম ভাপা পিঠা নামিয়ে শাল পাতায় রেখে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। কুড়ি টাকায় একটি পিঠে। বেশ ভালো আকারের। আর সুন্দর স্বাদের।
বেশ ভালই লাগলো আমার দেখতে এই তিনজনের কেমন একে অপরকে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে ওই শক্ত গুড়ের মতই মিষ্টি মধুর হয়ে বেঁচে থাকা। বেশ সুন্দর লাগলো ওদের দেখে আমার। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোথা থেকে এসেছেন আপনারা। মহিলার জবাব এই তো আমরা কাছেই থাকি পূর্বপল্লীতে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রতনপল্লীর সেই রাস্তার পাশের পোস্ট অফিসের সামনে বসি আমরা প্রতিদিন।
আজ মেলা হচ্ছে, এই নন্দন মেলা তাই এদিকে এসেছি আমরা না হলে ওটাই আমাদের স্থায়ী জায়গা বসার। হাতের কাজ করতে করতে মহিলা জানালেন আমায় কিছুটা স্বগতোক্তির মতই। জিজ্ঞেস করলাম মেলায় কোথায় বসবেন পৌষ মেলায়। মহিলা বললেন আমরা এই রতনপল্লীর এই জায়গায় বসবো। অন্য কোথাও যাবো না আমরা। এটাই আমাদের এক মাত্র ঠিকানা।
প্রতিদিন তো আর মেলার ভীড় হবে না এমন। তবু কেমন করে যেন তিনজন মিলে কঠিন কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন নিজেদের জীবনকে বাঁচার আর বাঁচানোর জন্য হাসি মুখে। সত্যিই অসাধারণ এই ভালোবাসার ভাপা স্পর্শ মাখা জীবন। যে জীবনে দশ, কুড়ি, ত্রিশ এর মাধ্যমে বেঁচে আছে ওরা হাসিমুখেই। কেমন ওই শিশির ভেজা ঘাসের ওপর ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা।
গরম গুড়ের হালকা স্পর্শ নিয়ে তৈরী করছে এই ফুরফুরে সাদা ভাপা পিঠের নরম ঝুরঝুরে আর ফুরফুরে স্বাদ। যার জুড়ি মেলা ভার। হ্যাঁ, সত্যিই রতনপল্লীর পোস্ট অফিসের কাছেই রাস্তার পাশে সন্ধ্যায় প্রতিদিন দেখতে পাবেন এদের তিনজনকেই। না, নাম জিজ্ঞাসা করিনি আমি কোনও। কি হবে নাম,পরিচয় , গোত্র এইসব জিজ্ঞাসা করে। ওরা তিনজন একে অপরকে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে আমাদের সবার সাথেই সবার মাঝেই। বেশ হাসিখুশি সেই জীবনের মেঠো রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা আপন ছন্দে।
ভাপা পিঠের স্পর্শ মাখা জীবন - অভিজিৎ বসু।
পাঁচ নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে নিজস্ব মোবাইল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন