ফোন আর আজকাল আসে না বিশেষ করে আমার কাছে। কেউ আর ডাকেও না আমায় কোথাও। বা নিমন্ত্রণও করে না আর আমায়। আসলে দিন দিন বেশ এই একা ঘর বন্ধ কুঠুরির মধ্যে বেঁচে থাকতে থাকতে কেমন যেন গুবড়ে পোকার মতো হয়েই বেঁচে আছি আমি। যা আমার চরিত্রের সাথে মিলেমিশে একদম একাকার হয়ে গেছে।
নানা চেনা মুখ, আত্মীয় স্বজনের ভীড়, তাদের কাছে খবর নেওয়া, হৈ হুল্লোড় করে মেতে যাওয়ার কোনো অবকাশ আর নেই আমার। এই তো বেশ দিব্যি আছি আমি। কি বা আসে যায় আমার কে ফোন করলো আর কে করলো না। কে পাত পেড়ে নিমন্ত্রণ খেতে ডাকলো তার বাড়িতে আর কে ডাকলো না। সে নিয়ে বিশেষ আকর্ষণ নেই আর আমার। কোনও মাথা ব্যথাও নেই।
কিন্তু এসবের মাঝেও যে কিছু কিছু ঘটনা জীবনে ঘটে যায়। যে ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দেয়। আগল তুলে বেঁচে থাকার মাঝেও কেমন করে যেনো আমার মনের আগল খুলে যায় হঠাৎ করেই। মনে হয় সত্যিই তো কেউ তাহলে আমায় ফোন করে ফেললো হঠাৎ করেই। বললো দাদা রবিবার আসতে হবে কিন্তু বাড়িতে। কারণ কি জানতে চাইলে বললো আরে দাদা নবান আছে যে বাড়িতে ভুলে গেলে হবে না কিন্তু একদম।
দিন কয়েক আগেই যে বাতাসপুরের নাম দেখে আমি অসীমকে কাজে নিয়েছিলাম সেই জল জীবনের কাজে। গ্রামে গ্রামে বিশুদ্ধ পানীয় জল পৌঁছে দেবার কাজে। সেই অসীমের ফোনে যোগাযোগ দাদা রবিবার কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসতেই হবে। কোনো ওজর আপত্তি শুনবো না আমি কিন্তু। সত্যিই তো সেই আমার প্রিয় বাতাসপুরের ডাক। সেই ডাককে উপেক্ষা করি কেমন করে। যে বাতাসপুর আমার বড়ো প্রিয়। যে বাতাসপুরের হিমেল হাওয়া খেতে আমার বড়ো ইচ্ছে করে বারবার। কি বলি আর বললাম হ্যাঁ,আমি চেষ্টা করবো নিশ্চয়ই।
আর এই বৃহস্পতিবার রাতে লক্ষ্মীবারে সেই সিউড়ি যাবার রাস্তায় গড়গড়িয়া গ্রাম পার হয়ে ইকড়া গ্রামের আমার প্রিয় শ্রীকান্তর ফোন। না, ফোন পেয়ে অবাক হতে হয়নি আমায় আর। দাদা রবিবার বাড়িতে নবান হবে। মা অন্নপূর্ণার আরাধনা হবে বাড়িতে। তাই সেই দিন আসতেই হবে আপনাদের সবাইকে বাড়িতে। মা অনেক করে বলেছেন কিন্তু। আমার প্রিয় সেই ইকড়া, বাতাসপুর এর গ্রামে বাস করা মানুষগুলোর কাছ থেকে ডাক পেয়ে কেমন যেনো মনটা ভরে গেলো আমার। যাদের সাথে কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই। আত্মীয়তার নিগূঢ় কোনো বন্ধন নেই তারা ফোনে নিমন্ত্রণ করলো আমায়। আসলে এই যে ডাকাডাকি করা, এই যে আমন্ত্রণ আর নিমন্ত্রণ এর মধ্য আন্তরিকতার কোনও শেষ নেই কিন্তু। যার জন্য এই ডাককে ফেলে দেওয়ার বুকের জোর আর সাহস নেই আমার। সত্যিই অসাধারণ এই নিমন্ত্রণ পত্র।
মনে পড়ে গেলো কবি জীবনানন্দ দাস এর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন। যে লাইন আমাদের বিমোহিত করে বারবার।
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হবো – কিশোরীর – ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলারি সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে।
হয়তো খৈয়ের ধান সরাতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায় – রাঙ্গা মেঘে সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে,
দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।
সত্যিই তো ভোরের কাক হয়ে নয়, শঙ্খচিল বা শালিকের বেশেও নয়। এই নবান্নের দেশের গ্রামের ডাক পেয়ে আমি কেমন যেনো আচ্ছন্ন হলাম। মনে হলো এটাই বোধহয় জীবন আর জীবনের মাঝে এক অন্য অনুভূতি আর তার অনুরণন। কেমন শিহরণ খেলে গেল আমার হৃদয়ে। যে গ্রাম বাংলায় নদী, মাঠ, ক্ষেতকে ভালোবেসে বাতাসপুরের বাতাস মেখে ঘুরে বেড়াতে বড়ো সাধ হয় আমার। জীবনের এই শেষ হেমন্তের বিকেল বেলায় গড়গড়িয়া গ্রাম এর পশ্চিমের মাঠে নদীর ধারে ঢলে পড়া সূর্যের মিঠে উত্তাপ গায়ে মেখে কেমন করে যেন গড়াগড়ি খেতে বড়ো সাধ হয় আমার মাটিতে।
জীবনের হাজারও প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির মাঝে লুকিয়ে থাকা এই পাশুটে জীবনকে গলা উঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করে দেখো দেখো এই আত্মসর্বস্ব পৃথিবীতে একদম একা আমি নয়। স্বজনহীন, আত্মীয়হীন, বন্ধুহীন হলেও বাতাসপুর এর বাতাস আমায় হিমেল সন্ধ্যায় কেমন করে যেনো আপন করে নেয় তার আকুল করা ডাক দিয়ে। যখন শিমুলের ডালে বসে থাকা লক্ষ্মীপেঁচা ডাক দিয়ে বলে এই তো আমি আছি। যেখানে সেই অঘ্রাণ এর সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা ধবল বক ডেকে বলে এই তো আমি আছি। সেই ঘুঙুর এর ডাক আমায় আচ্ছন্ন করে।
চারিদিকের এই ডাক আমার মনের আগল খুলে দেয়। গুবড়ে পোকার মতো বেঁচে থাকা জীবনে কেমন যেনো একটা ঝড় ওঠে। মনে হয় ওই কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে আমি ওদের কাছে ছুটে যাই। সেই নতুন ধানের শীষের গন্ধ গায়ে মেখে। সেই নতুন ভেজা চালের সোঁদা গন্ধ, সেই মাটির গন্ধ, সেই শহুরে জীবনের হাতছানি এড়িয়ে গ্রামের মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলি আমি একা একাই। আমার আশপাশে কত ভীড়। আকুল করা ডাক। আমন্ত্রণ আর নিমন্ত্রণ। কেমন করে যে এই স্থবির বন্ধ্যা জমিতেও ফসল ফলে কে জানে।
নবানের আকুল ডাক - অভিজিৎ বসু।
ছয় ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন