মহাকরণে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে প্রবেশ করলেই বা মহাকরণের গেটে পা দিলেই যার সাথে আপনার দেখা হবেই সেই অংশু চক্রবর্তীদার সাথে আমার কবে কিভাবে আলাপ হলো সেটা আজ আর মনেই নেই আমার এতদিন পরে। সেই বাম আমলের পুরনো মহাকরণ, আজকাল পত্রিকা, সাদামাটা নিপাট একদম হাসিখুশি একজন রিপোর্টার, জয় মাকে স্মরণ করে এগিয়ে চল ভাই বলা একজন ভদ্র সাংবাদিক। যার চোখে মোটা ফ্রেমের হাই পাওয়ার এর চশমা, মুখে অল্প হাসি, বুক পকেটে একটা পেন উঁকি মারছে সব সময়, প্যান্টের পকেটে নোট বুক, দ্রুত মন্ত্রীর ঘরে বা সচিবের ঘরে নোট নিতে পারা একজন সুদক্ষ সাংবাদিক। আমরা মন্ত্রী কি বলেছেন ভুলে গেলেও অংশুদার সবটাই মুখস্থ গড়গড় করে বলে দেবেন তিনি আমাদের যেটা তাঁর সবথেকে বড়ো গুণ।
যে হাসতে হাসতে বলতে পরে কাল সকালে একটা কাগজ কিনে দেখে নিও ফার্স্ট পেজ লিড বা সেকেন্ড লিড স্টোরি হয়ে গেলো আমার সাত সকালেই। এক পকেটে লিড নিউজ পাওয়ার পরে অন্য পকেটে আরও একটা এসে গেছে প্রায়। আর সেই সময় সেই রোগা চেহারার আনন্দবাজার পত্রিকার সেই শুট বুট পরা শ্যামল দা হেসে বলতেন এই তো আমার কাছেও আছে একটা এক্সক্লুসিভ খবর এই ঘুরে এলাম আমি মন্ত্রীর ঘর থেকে।
আর এর মাঝেই সেই বিখ্যাত শ্যামলেন্দু মিত্র, প্রভাত ঘোষ, সুকান্ত মুখোপাধ্যায়, এমন কত জন যে ছিলেন সেই সময় প্রেস কর্নারে। ছিলেন কাজী ইলাহী দা সিটিভিএনের। বেশ ভালই ছিল আমাদের সেই হাসিখুশি প্রেস কর্ণারের পুরোনো মহাকরণের সংসার। সেই শীতের সময় রোদ পোহানো বারান্দায় বসে রিপোর্টারদের। আর মন্ত্রী গেলেই উঠে দাঁড়ানো কি খবর আছে বলে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়া। সেই চা খাবার ইচ্ছা হলেই প্রেস কর্ণারের পাশের মন্ত্রীর ঘর অরূপ রায় এর ঘরে ভীড় জমানো, গল্প করা আর মন্ত্রী বলতেন চা খেয়ে যাও তোমরা। সত্যিই বেশ ভালো সাংবাদিকতার দিনগুলো বেশ কেটেছিল সেই সময়।
প্রথম যেদিন প্রেস কর্নার পা দিলাম আমি অংশুদাকে দেখে তার কথা শুনে একটু ভয় পেয়েছিলাম। দীর্ঘ ত্রিশ বছর বা তার বেশি সময় ধরে একজন মহাকরণের অলিন্দে ঘুরে বেড়ানো একজন রিপোর্টার। দাপট না দেখালেও একটা ভয় আর শ্রদ্ধা কাজ করেছিল। পরে ধীরে ধীরে সেটা কেটে যায়। সেই আমি, তরুণ দা নিউজ টাইম এর, সেই রূপম চট্টোপাধ্যায় দা, সেই ইটিভির সাধু দীপক দাস, সেই কাজী ইলাহী দা, সবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল সেই সময়। এদের সাথেই আমিও ঘুরতাম বলে ছোটো হয়েও ভীড়ে গেছিলাম আমি তাদের দলেই। বেশ ওই সিং ভেঙে বাছুরের দলে প্রবেশের মত ব্যাপার আর কি।
কিন্তু কোন দিন কোনো সময় সিনিয়র হলেও অংশু দাকে খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি কারুর সাথে। ছোটদের সাথে কোনোদিন এমন করে দূরে ঠেলে দেননি যে সে ভয় পাবে সে তাঁকে। উল্টে সাহায্য করতে প্রস্তুত সবসময়। যেটা আজও মনে পড়ে আমার মিডিয়াতে কাজ না করেও। এমন মাঝে মাঝেই দেখি আমার লেখায় মন্তব্য করে অংশুদা এগিয়ে চল ভালো থাকিস। মাঝে মাঝেই কথা হয় কি খবর রে তোর। সব ভালো তো। মায়ের আশীর্বাদে সব কিছু ঠিক চলে যাবে রে। রামকৃষ্ণ আর মা সারদার একনিষ্ঠ ভক্ত অংশু দা।
হিন্দমোটর এলাকায় বাড়ী আমার নিজের জেলা
হওয়ার কারণে একটু বেশি ভালোবাসতো আমায় বরাবর। একদিন মহাকরণ ছেড়ে দিয়ে চলে আসার পর সেক্টর ফাইভের একটি নর্থ ইস্ট এর গৌহাটির বাংলা চ্যানেল এর অফিসে হাজির অংশু দা একদিন দুপুর বেলায়। সেই চেনা মুখের হাসি, কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ, আজকালের কোনো ব্যাংক এর কাজে সেক্টর ফাইভ এসেছিলেন। নতুন টিভি চ্যানেল এর অফিস হয়েছে শুনে দেখা করে গেলেন পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক্সিকিউটিভ এডিটর এনকে বাংলার অফিসে। আমার সাথেও দেখা হলো। হেসে বললেন, এগিয়ে চল ভাই। আমি সব শুনলাম তুই কাজ পেয়েছিস ভালো করে কাজ কর মন দিয়ে কাজ কর। জয় মা মঙ্গল কামনা করি। বলে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম জানালেন। এই হলো আমাদের সবার প্রিয় অংশুদা। সেই ধরি মাছ না ছুঁই পানি এই আপ্ত বাক্য স্মরণ করে যে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলো হাসতে হাসতে।
কতবার যে দুজনের শান্তিনিকেতনের গ্রামে জমি কেনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার ঠিক নেই। একচিলতে জমি, একচিলতে মাটির ঘর, কাঠকুটো জ্বেলে একটু রান্না করা একবেলা, আর সন্ধ্যায় মার নাম গান কীর্তন। শুধুই সাধন আর ভজন। এটাই আসল জীবন। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন আর সত্যিই হয়নি কিছুতেই। উপায় নেই আমার এই অবস্থায়। তবু মাঝে মাঝেই খবর নেয় আমার অংশুদা। বলেন কি খবর রে ভালো আছিস তুই। মনে পড়ে যায় সেই মহাকরণের নানা টুকরো টুকরো কথা। সেই হীরক কর, অংশু চক্রবর্তীর অমলিন বন্ধুত্বের সম্পর্কের কথা। যে গভীর গোপন কথা হয়তো কেউই জানে না আজও। সেই অংশুদার আজকালের চাকরির কথা। সেই ওভারল্যান্ড এর কাজ এর জীবনের কথা। দীর্ঘ এই সাংবাদিকতা জীবনের কত কিছুই যে লুকিয়ে আছে গভীর গোপন অভিজ্ঞতা সম্পর্ক আর অনুভূতির কথা কে জানে।
একদম চুপ করেই সারাটা জীবন যে মানুষটা মহাকরণের অলিন্দে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়িয়ে শুধু খবর করেই কাটিয়ে দিলো। একদম সহজ সরল উপায়ে জীবন যাপন করেই বাঁচতে যে ভালোবাসে। সেই ভোট এলেই যাঁকে দেখা যেতো সেই নির্বাচন কমিশনের অফিসে। প্রেস কনফারেন্স হলেই নোট নিতে দেখা যেতো তাঁকে রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশে গভীর মনোযোগ দিয়ে নোট নিচ্ছেন চোখে চশমা পরে গম্ভীর মুখে। সেই অংশু দা কোনোদিন কাগজ ছেড়ে টিভিতে কাজ করতে চায়নি।
সত্যিই এমন সাদামাটা নিপাট একজন রিপোর্টার এত বিরাট যার সাংবাদিক জীবন কেমন যেনো নির্মোহ হয়েই কাটিয়ে দিলেন তিনি হাসিমুখেই শুধু জয় মা বলে। বাম আমলের সময়ে মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, আবার তৃণমূল আমলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর সাথে কাজ করা এই রিপোর্টার এর ঝুলিতে যে কত গল্প, কত ইতিহাস জমে আছে কে জানে। তবু খুব সতর্ক এই রিপোর্টার কিছুই বলতে চায় না। হয়তো অবসর এর পরে বই লিখবেন তিনি।
আজ রাতের অন্ধকারে মনে হলো মহাকরনের এই আদিকালের এক এই প্রবীণ সাংবাদিক এর কথা কিছু লেখা দরকার। যে এখনও আমায় মনে রেখেছে এত দিন পরেও, আমার সাংবাদিক জীবন স্বেচ্ছায় চলে যাওয়ার পরেও। যে হঠাৎ ফোন করে মেয়ের কি খবর পড়া হচ্ছে তো ওর খবর নেয় আমার কাছে। যে বলে তুই কোথায় বোলপুরে না শ্রীরামপুরে। যে বলে এগিয়ে চল ভাই তুই।
সত্যিই অসাধারণ লাগে আমার এই সব কথা শুনে। আমার মনে পড়ে যায় হারিয়ে যাওয়া আমার সাংবাদিক জীবন, হারিয়ে যাওয়া সেই মহাকরণ, সেই লম্বা করিডোর, সেই প্রেস কর্নার, সেই ঘোরানো ফোন, সেই নানা সাংবাদিকদের ভীড়, সেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের বাইরের পোডিয়াম, সেই আমার হারিয়ে যাওয়া সরকারি প্রেস অ্যাক্রিডেশন কার্ড, যে কার্ড ডিসেম্বর মাস পড়লেই বছর শেষ হলেই নতুন কার্ড পেতাম আমি, সেই আমার হারিয়ে যাওয়া খবরের দুনিয়ার মাঝে অংশুদার একটা ফোন কত কিছুই যে মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেয় আমায়।
ভালো থেকো তুমি অংশু দা। এইভাবেই এমন করেই মাঝে মাঝেই ফোন করো তুমি। বেশ ভালো লাগবে আমার। সত্যিই জীবন বড়ো বিচিত্র, জীবন বড়ই স্মৃতিমেদুর, যে মাঝে মাঝেই লুকিয়ে লুকিয়ে এই শীতের নিশুতি রাতে স্মৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। স্মৃতিকে আগলে রেখেই বাঁচতে চায়। কে বলে স্মৃতি বড়ো বেদনার।
রাইটার্স এর অংশু দা - অভিজিৎ বসু।
ষোলো ডিসেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন