ছবির মাথায় লেখা জ্যোতিদার ফেয়ারওয়েল। যাঁর জন্য এত আয়োজন তাঁর মুখের সেই চেনা হাসি লেগে আছে আজও একভাবেই। এই কর্মজীবনের শেষ দিনেও, কষ্টের মাঝেও হাসতে ভোলেনি সে। আমার মনে পড়ে গেল সেই সিঙ্গুর বড়া তেলিয়ার মোড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর সভা চলছে। সেই সভায় এবিপি আনন্দের ওবি ভ্যান ভাঙচুর করা হচ্ছে। এক নম্বর চ্যানেলের রিপোর্টার বিতনু বোধহয় আর তার ক্যামেরা ম্যান সেদিন কে ছিল নাম মনে নেই আমার আশপাশে নেই কোথাও। ভাঙচুর করার সুযোগ করে দিয়ে ভীড়ে গা ঢাকা দিয়েছে বোধহয়। যাতে ওবি ভাঙার ছবিটা ভালো করে হয় সবাই দেখতে পায় রাজ্যে জুড়ে। তৃণমূলের সভায় মিডিয়ার ওবি ভাঙার ছবি।
মঞ্চে তখন উপস্থিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায়, বেচারাম মান্না সহ আরও অনেকেই। আমার চোখের সামনে সংবাদ মাধ্যমের গাড়ি ভাঙা হবে আর আমি দাঁড়িয়ে থাকবো চুপ করে সেটা হয় কি করে। আমার রক্ত গরম হয়ে উঠলো সেটা দেখেই। মিন্টেকে বললাম, চলো তো দেখি কারা ভাঙচুর করছে এরা কারা সব। হ্যাঁ, কোনো দিনও ভয় পায়নি, বলেনি না, যাবো না ওখানে ঝামেলা হচ্ছে। আমরা ভীড় ঠেলে ওপরে গেলাম ছবি করতে। রানা হলে কি বলতো বা কি করত আমি জানি না সেটা।
আর তারপর দেখলাম ছবি তোলার জন্যে ক্যামেরা তাক করতেই ওর মাথায় ইঁটের ঘা খেয়ে দরদর করে রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর মুখ চোখ আর নাক। নিজেই হাত দিয়ে সামাল দিচ্ছে কোনরকমে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর সারা শরীর। আমি তখন দিশেহারা। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। খুব সম্ভবত মনে নেই আমার দিলীপ যাদব দৌড়ে এলো বোধহয় সেটা দেখে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো ওকে। সেদিনও সেই সময় হাসপাতালে যাবার সময় সেই রক্তস্নাত ম্লান মুখে হাসি ছিল ওর। হাজার কষ্টের মধ্যে আমি ঠিক আছি গো, তুমি চিন্তা করোনা। আমি ঠিক আছি এই কথা বলে আমায় আশ্বস্ত করেছিল সেদিন মিন্টে। পরের ঘটনা ইতিহাস গোটা রাজ্য জুড়ে ওর রক্ত মাখা মুখের ছবি প্রচারে এনেছিল সিপিএম। আর শ্রীরামপুরে ওয়ালস হাসপতালে মিন্টেকে ফুল নিয়ে দেখতে গিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর মদন মিত্র আমার তাড়া খেয়ে হাসপাতাল ছাড়লেন কোনরকমে।
আজ নবান্নে দাঁড়িয়ে ওর এই ফেয়ারওয়েলের দিনে এই নানা ছবি, ফুল, মিষ্টি, উপহার নানা মানুষের ভীড় দেখে মনে পড়ে গেলো আমার সেই ফেলে আসা দিনের নানা এমন সব কথা। যে দিনগুলোর ঝড় ঝাপটা সামলে আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে আর আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিলাম বিন্দাস খবর করে চার আর ছক্কা মেরে। যে খবরের নেশায় দৌড়ে আমরা হাঁফিয়ে পড়িনি কোনোদিনই। আসলে একজন সাংবাদিক সে চিত্র সাংবাদিক হোক বা খুঁটে খবর জোগাড় করা কলম পেশা সাংবাদিক হোক তার কি সত্যিই কোনোদিন, কোন সময় অবসরে যাওয়া হয়। তার মনে কি খবরের সেই টান কোনোদিন একেবারেই শেষ হয়ে যায়। ক্যামেরার লেন্সে চোখ না রাখলেও কি ভালোবাসা কমে যায় কোনো ভাবেই ক্যামেরা আর কলমের প্রতি আর খবরের প্রতি। আমার মনে হয় না।
আর তাই সেই বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান শ্যামল মৈত্রর
শিষ্য ও। ওর সেই শ্যামল কাকুর হাত ধরেই স্টিল ফটোগ্রাফিতে পা রাখা। সেখানে হাত পাকিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো। একটা কাগজে ছবি বের হলে টাকা না পেলেও আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়া। কোনভাবে এদিক সেদিক করে দাদা আর ভাই মিলে মিন্টে আর ঝন্টে মিলে সংসার চালানো সেই ভাঙা ভাড়া বাড়িতে। আর সেই স্টিল ক্যামেরা থেকে কেমন করে যেন ও ভিডিও ক্যামেরার জগতে প্রবেশ করলো কিছুটা আমার হাত ধরেই।
সৌরভ বন্দোপাধ্যায় ইটিভি ছেড়ে দিয়ে এবিপি আনন্দে কাজ করতে চলে যাওয়ায় মিন্টে হলো আমার সেই ইটিভির হুগলীর অফিস ক্যামেরাম্যান। সেই লরেল আর হার্ডির জুটি কাজ শুরু করলো হুগলী জেলায়। আজ ঝগড়া তো কাল ভাব। আজ কথা বন্ধ তো কাল একসাথে চা খেয়ে টিফিন খেয়ে খবর করতে ছুটে যাওয়া। এমন জুটি ছিল আমাদের দুজনের। যে জুটি বহুকাল আগেই আমাদের ভেঙে গেছে। আমি বহুকাল আগেই সময়ের আগেই অবসরে চলে গেছি টোটো চালক হয়ে। আর আজ ওর অবসর হলো। বেশ মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার ওর এই নবান্নের ছবিটা দেখে।
যে ছবির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে কত মিষ্টি মধুর স্মৃতি। সেই মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর সফর সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেড়ানো বিভিন্ন জেলায়। সেই নির্বাচনের উত্তাপে এই জেলা থেকে ওই জেলা সফর করে ঘুরে বেড়ানো ভোটের উত্তাপ গায়ে মেখে। হাসি মুখে এই বয়সেও কেমন সব সামলে দেওয়া সেই সুন্দর হাসি দিয়েই আর ওর কাজ দিয়েই।
আজ সেই নানা কথা মনে পড়ে গেলো আমারও। যে মাঠ থেকে ছিটকে গেছি আমি নিজেই বহুকাল বহু দিন আগেই। সেই কঠিন এবড়ো খেবড়ো মাঠে কি সুন্দর ব্যাট করলো মিন্টে হাসি মুখে সব কিছুকে সামাল দিয়ে। চার, ছয় আর সিঙ্গেল রান নিয়ে। সেঞ্চুরি করে মাথার ওপর ব্যাট তুলে টুপি খুলেভমাথা উঁচু করে ক্রিজ ছাড়লো ও। আজ সত্যিই ওর জন্যে আমার গর্ব হয়। আমি যা পারলাম না সেটাই ও করে দেখালো। ভালো থেকো তুমি মিন্টে। অবসর জীবনেও ভালো থেকো তুমি।
অবসরেও হাসি মুখে মিন্টে - অভিজিৎ বসু।
এগারো ডিসেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন