আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে খবর করে পুরষ্কার জোটেনি খুব একটা কোনোদিনই। বরং মার আর তিরস্কার জুটেছে ভালই। আমার এই পঁয়ত্রিশ বছর এর জেলার মেঠো সাংবাদিকতায় পুরস্কার এর চল বিশেষ ছিলো না খুব একটা সেই সময়ে। আমাদের সময়ে সিনিয়রদের একটু পিঠ চাপড়ানো, বাহ দারুন খবর হয়েছে এতেই আমাদের বিরাট প্রাপ্তি হতো যেনো। আনন্দে আর গর্বে বুক ফুলে উঠতো আমার। আর খুব বেশি হলে সেই রামোজি রাও এর হায়দরাবাদ এ চেয়ারম্যান এর মিটিং এ সবথেকে বেশি স্টোরি করার জন্য তালিকায় নাম ওঠে। তাহলে তো আর কোনও কথাই নেই সেই রিপোর্টার এর। যে নাম বহুদিন ধরেই একনম্বরে ছিল আমার নাম। জেলা হুগলী জেলা। রিপোর্টার অভিজিৎ বসু।
আসলে আজকাল খবরের দুনিয়া অনেকটাই বদলে গেছে অভিযোজিত হতে হতে। ঠিক যেনো সেই চার্লস ডারউইনের সেই বিবর্তনবাদের মতোই। এই খবরের দুনিয়ায় শুধুই খবর করে আর জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়না। চুপটি করে ঘাপটি মেরে একা একাই নিরুপদ্রব জীবন সেটা যেনো আজকাল সোনার পাথর বাটি আর কি। তার সাথে সাথে, মানে খবর করার সাথে সাথে নিজেকে বেচতে হয় এই খবরের নক্ষত্রলোকের আলোকোজ্জ্বল দুনিয়ায় সঠিক ভাবে। নিজেকে বেচতে জানতে হয় সবার মাঝে। আর না হলে পিছিয়ে যেতে হয়। ক্রমেই পিছিয়ে যেতে হয়।
নিজের খবরকে বেচা, খবরের সাথে নিজেকে বেচা, যে রিপোর্টার যে বিটের, সেই বিটের নেতা বা নেত্রীকে তাঁর সোর্সের দেওয়া খবরকে সঠিক ভাবে বেচা, নিজের খবরের মাধ্যমে ওই বোকা বাক্সের পর্দায় সেটাকে ঠিক ভাবে প্রতিফলিত করা। আর এটাই এখন খবরের দুনিয়ার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে যেনো। শুধু খবর বেচলেই তার কাজ শেষ নয়, অফিসের বসের কাছে নিজেকে বেচা, রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীর কাছে নিজেকে বেচা। সোর্সের কাছে নিজের অজান্তেই দায়বদ্ধ হয়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে বেচে দেওয়া। আর এই পদ্ধতিতেই চলছে নয়া খবরের নতুন ঝকমকে দুনিয়া। যদি এই সবের কোনওটাই না করতে পারো তাহলে দরজায় খিল এঁটে বসে থাকতে হবে অন্ধকার ঘরে একা একাই। এটাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাংলা মিডিয়াতে।
শুধু মিডিয়া কেনো রাজনীতির ময়দানেও এই ভাবেই নিজেকে বেচে, নিজেকে বদলে ফেলে, নিজেকে সঁপে দিয়ে, বেঁচে থাকতে হবে সকলের সাথে হাসি মুখে ভাবটা এমন যেনো কত ভালই না আছি আমি। হাজারো কষ্ট সহ্য করে অপমানকে হাসি মুখে মাথা পেতে নিয়ে বেঁচে থাকার অভিনয় করে যেতে হবে। আর না পারলে মাঠের ধারে সাইড লাইনে অপেক্ষা করতে হবে এক্সট্রা প্লেয়ার এর মত। যদি কোনোদিন ডাক পড়ে মাঠে নামার এই আশায়। যদি কেউ চোট বা আঘাত পায় সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকা।
তাই এই উজ্জ্বল মুখের নক্ষত্রলোকের সব বাসিন্দাদের দেখে আমার মনটা ভরে যায়। বুকটা গর্বে ভরে যায়। যা আমি পারিনি আমার জীবনে সেটাই ওঁরা সবাই কেমন অক্লেশে হাসতে হাসতেই করে ফেলেছে এই এক জীবনেই। যার জন্যে তাদের কোনো রকম টেনশন হয়নি। তাঁদের মনে হয়নি যে এইভাবে নিজেকে খবরের দুনিয়ায় বেচতে গিয়ে যদি কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে যায়, একটু হলেও পা পিছলে যায়, একটু হলেও ঝুঁকে যেতে হয় ডান বা বাম দিকে তাহলে কি হবে।
তাহলে যে আর ঠিক এইভাবে হাসিমুখে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে মঞ্চে হাজির হওয়া যাবে না কোনোদিনই। আর তাই বোধহয় এইসব কিছু হতে পারে আঁচ করেই তাঁরা সবাই মিলে সতর্ক হয়ে পা ফেলে একসাথে হাতে হাত ধরে জোট বেঁধে হিসেব নিকেশ করেই।
এই নানা চেনা উজ্বল মুখের মাঝে যে মুখকে দেখে সত্যি আমি মুগ্ধ হলাম আমার মনে আনন্দ হলো খুব। সেই আমার দাদা, চব্বিশ ঘণ্টার আমায় ডেকে চাকরি দেওয়া সেই এডিটর অনির্বাণ চৌধুরীদা। তাঁর হাতে পুরস্কার দেখে সত্যিই আমি বিমোহিত । একসময়ে ইংরেজি কাগজের অফিসে কাজ করা একজন হৈ হুল্লোর করে সময় কাটিয়ে দেওয়া একজন ক্যাজুয়াল সাংবাদিক থেকে টিভি চ্যানেলের একজন সিরিয়াস সাংবাদিক হিসেবে, এডিটর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি বিন্দাস হয়ে।
অনেক ঘসে মেজে নিজেকে এমনভাবে তৈরি করলেন, সবার সামনে ঝকঝকে করে নিজেকে দাঁড় করালেন সেটা দেখেও মাঝে মাঝেই অবাক হয়ে যাই আমিও। বস হয়ে যা তিনি প্রায় অবসরের সময় এসে আমাদের সবাইকে করে দেখালেন তিনি। আমরা সেটা মধ্য পঞ্চাশে পৌঁছেও করতে পারলাম না কিছুতেই।
সত্যিই অসাধারণ এই ছবি। এই জন্যেই বলে বস ইজ অলটাইম রাইট। তিনি ভুল করতেই পারেন না কোনও সময়, কোনও দিন।
যা আমরা করতে পারিনি সেটাই উনি করে দেখালেন হাসতে হাসতেই। এই ঘুর্ণি বলের কঠিন পিচে তিনি ধরে ধরে ব্যাট করে নট আউট থেকে গেলেন কেমন করে। আর বসের এই কঠিন পিচে ব্যাট করা দেখে বসের এক সময়ের সব গুণমুগ্ধ ভক্তরা, আমরা সব কেমন যেন চুপ করে গেছি। এই নিজেকে বদলাতে না পারা শিষ্যরা একদম স্পিকটি নট। তাদের মনে একটাই কথা কেনো যে নিজেকে বেচতে পারলাম না আমিও। তাহলে তো ওই উজ্জ্বল নক্ষত্রলোকের সন্ধান আমিও পেতাম।
চেনা মুখ অচেনার ভীড়ে - অভিজিৎ বসু।
আঠারো ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন