সাদা জীবনের কালো কথায় আজ সেই হারিয়ে যাওয়া ক্যামেরাম্যান পুষ্পর কথা। কোথায় যে গেলো মেয়েটা কে জানে। বছরখানেক আগে হাজরা মোড়ে বাংলা জাগোর অফিস থেকে ফেরার সময় দেখলাম রাতে দাঁড়িয়ে আছে ও বাস ধরবে বলে। কোনো একজন রিপোর্টার এর সাথে কথা বলছে ও। নিজেকে কিছুটা লজ্জায় আমি ওর সাথে কথা বলতে চাইনি। কিন্তু ওই বললো অভিজিৎ দা কি খবর গো কেমন আছো তুমি। আমি বললাম চলে যাচ্ছে। আসলে চব্বিশ ঘণ্টার চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটু মুখ লুকিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। এই সব চেনা মানুষগুলোর থেকে কিছুটা দূরে থাকা। এই আর কি আর কিছু নয়।
দেখলাম সেই রোগা চেহারা। চোখে চশমা। কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগটা নেই। চিন্তান্বিত মুখ। বাড়ি ফিরছে ও সারাদিন পর কাজ সেরে। সরকারী বাস এর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ও। যদি সরকারি বাস পাওয়া যায় তাহলে একটু বিনা ভাড়ায় হাওড়া স্টেশন যাওয়া যায় আর দুটো পয়সা বাঁচে তার। এটা অবশ্য বেশ ভালই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে মা মাটি মানুষের সরকার। দুজনেই আমরা বাস এর অপেক্ষায়।
কত কথা যে মনে পড়ে যায় আমার। সেই মহাকরণের কাঁচের দরজা ঠেলে কাঁধের বিরাট ঢাউশ একটা ব্যাগ নিয়ে প্রেস কর্নারে এসে বসা ওর। তারপর ওকে দেখেই চব্বিশ ঘণ্টার বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান সুনীল এর বলা কি রে আজ এত দেরি হলো যে পুষ্প। আর সেই সিএন নিউজ এর পিন্টুর খৈনি খেতে খেতে বলা কিছুই খবর হয়নি চুপ করে বোস তুই সবে এসেছিস এখন রেস্ট নে। একজন মেয়ে হয়েও কি করে যে ও এমন ক্যামেরাম্যান হয়ে গেলো কে জানে সেই গল্প আমি জানি না একদম। কিন্তু প্রেস কর্নারে সেই রোগা মহিলা ক্যামেরাম্যান পুষ্পার মনের জোর ছিল অসাধারণ। সেই জিন্সের আধ ময়লা প্যান্ট আর গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে ওর হাসি মুখে ঘুরে ঘুরে সবার সাথে কথা বলা। দুপুর বেলা বাড়ি থেকে শুকনো রুটি আর তরকারী এনে ভাগ করে খাওয়া। যা দেখে আমি বেশ ওর ফ্যান হয়ে গেছিলাম।
আর কোনো সাংবাদিক বৈঠক হলে সবার মতোই কি সুন্দর ক্যামেরার ফ্রেম করে লেন্সে চোখ লাগিয়ে সেই বৈঠক কভার করা ওর ছোটো খাটো চেহারা নিয়েও। যা দেখে আমি বেশ মুগ্ধ হতাম। এত গেলো ইন্ডোর এর কাজ। কিন্তু সেই রাস্তায় কত যে খবরে আর ইনসিডেন্ট এর কভার করতে গিয়ে ওর সেই বিখ্যাত ক্যামেরা নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো। হাঁফাতে হাঁফাতে যে কোনো খবরে ভয় না পেয়ে ওর ছবি তুলে ফেলা কাউকে পরোয়া না করে। যে কোনও পুরুষ ক্যামেরাম্যানদের সাথে একদম পাল্লা দিয়েই সমান তালে তাল দিয়ে পাল্লা দিয়েই কাজ করা। যা দেখে আমার মনে হতো সত্যিই পৃথিবীটা তাহলে অনেক বদলে গেছে। আর শুধুই পুরুষদের আধিপত্য বিস্তার করে একচেটিয়া তাদের বাজার দখল করা নয়। সেই বাজারে মেয়েরাও কেমন দ্রুত এগিয়ে আসছে।
মহাকরণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর ছোট্ট মেয়ের পড়াশোনা আর ওর মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওর খুব চিন্তা ছিল রাতদিন। মেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করতে চায় না হলে যে মেয়েটা মানুষ হবে না কিছুতেই। তার মতো ক্যামেরা ব্যাগ নিয়ে যেনো মেয়েকে ছুটে মরতে না হয়। আর তাই চন্দননগরে সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করতে চায় মেয়েকে। আমার মেয়ে যেহেতু ওই স্কুলে পড়ত তাই আমর কাছেই সব খবর নিত ও সেই সময়। একদিকে খবরের কাজ এর চিন্তা, ক্যামেরা নিয়ে দৌড়ে ছবি করার চিন্তা আর অন্য দিকে মেয়ের ভর্তির চিন্তা আর তার ভবিষ্যতের চিন্তা এই নিয়েই দিন কেটে যেতো পুষ্পর।
বহুদিন পড়ে শ্রীরামপুর স্টেশনে নেমে দেখা হলো ওর সাথে আমার একদিন। অভিজিৎ দা কি খবর গো। আমি বললাম চলে যাচ্ছে কোনও রকমে। পুষ্প বললো মেয়ে চন্দননগর স্কুলে ভর্তি হয়েছে দাদা। এখন পড়ছে মেয়ে ওই স্কুলে। আমি বললাম বাহ দারুন খবর তো। আর আগেও একটি চ্যানেলে লোক নেওয়ার খবর পেয়ে ও আমায় ফোন করেছিল একদিন। যদি কোনো কাজের সুযোগ হয়। সেটা আর হয়নি সুযোগ ওর কাজের আমি চেষ্টা করলেও।
জানি না আমি আজ এখন ও কোথায় আছে। কি করছে। ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে এখনও দৌড় দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে কি না সংসারের জন্য। বহুদিন দেখা হয়নি ওর সাথে। দেখা হয়নি সেই চব্বিশ ঘণ্টার ক্যামেরাম্যান সুনীল এর সাথে সব সময় গুটখা আর পান খেতো যে। যে আমার জন্মদিন পালন করেছিল মহাকরণের প্রেস কর্ণারে। সুন্দর ঘড়ি উপহার দিয়েছিল সবাই মিলে। সেই বয়স একটু বেশি উৎপল দা। হাঁটুর ব্যাথা নিয়েও হাজির হতেন প্রেস কর্নারে দুপুর বেলায় হাসিমুখে।
এমন কত যে মানুষজন এর কথা মনে পড়ে যায় আমার। তবে আজ এই রাতে হারিয়ে যাওয়া পুষ্পর কথা মনে হলো হঠাৎ করেই। সেই শীতের দুপুর। সারি দিয়ে মহাকরণের প্রেস কর্নার এর সামনের বারান্দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা সাংবাদিক আর ক্যামেরা ম্যানদের জটলা। হঠাৎ করেই মহাকরণের মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের বাইরে নিরাপত্তা রক্ষীদের তৎপরতা। সাংবাদিক বৈঠক করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আর সব গল্প ছেড়ে দৌড় আর দৌড় আর দৌড়। সেই ক্যামেরা স্ট্যান্ড পাতার ভীড়, ঠেলাঠেলি করা একে অপরকে। সেই সাংবাদিকদের একটু মাটিতে মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে বসে পড়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার দুর্নিবার প্রচেষ্টা করা। আর মনের মত প্রশ্ন করে মূখ্যমন্ত্রীর কাছে একটু ভালো হবার চেষ্টা করা আর পয়েন্ট পাবার আশায় অপেক্ষা করা। আর এইসবের বাইরে গিয়ে উল্টো স্রোতে ভেসে গিয়ে কেউ কোনো অপ্রাসঙ্গিক কথা বা প্রশ্ন করলেই তাকে রে রে করে একদল সাংবাদিকের তেড়ে আসা।
সত্যিই কত যে এমন স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেই সব দিনগুলোর মাঝে কে জানে। আজ হারিয়ে যাওয়া সেই ক্যামেরাম্যান পুষ্পর কথা লিখতে গিয়ে সব কিছুই ভেসে এলো যে। বন্ধ হয়ে গেছে মহাকরণের সেই প্রেস কর্নার। আর ভীড় নেই সেই পুরোনো দিনের প্রেস কর্নারে। দেখা যায়না কাউকেই। হারিয়ে গেছে মহাকরণের সেই ফেলে আসা দিন গুলো।
ভালো থেকো তুমি পুষ্প। মেয়েকে ভালো করে পড়াও তুমি। মানুষ করো মেয়েকে। তোমার স্বপ্ন সফল হোক। ভগবানের কাছে আমি এই প্রার্থনা করি। তোমার এই সংসারের জন্য, মেয়ের জন্য কঠিন কঠোর লড়াই নিশ্চয়ই একদিন সফল হবেই। তুমি ভালো থেকো পুষ্প।
হারিয়ে যাওয়া ক্যামেরাম্যান পুষ্প - অভিজিৎ বসু।
ঊনত্রিশ ডিসেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন