সত্যিই বছর শেষে এই উৎসবের আয়োজন, উৎসবের এই প্রকাশ, উৎসবের এই আতিশয্য বেশ মুগ্ধ করলো আমায়। তাহলে এতদিন এমন অনুষ্ঠান তো হয়নি আগে কখনো কোনোদিন। কেউ তো ভাবেইনি প্রভু যীশুকে নিয়ে এইভাবে। সত্যিই যীশুকে নিয়ে এই ভাবনা, প্রভু যীশুকে এই ভাবে সুন্দর মোড়কে মুড়ে হাসি মুখে তাঁকে বেচে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বেশ মুগ্ধ করলো আমায়। সত্যিই এই আমলে বোধহয় সবকিছুই বেচা যায়। চাকরি থেকে শুরু করে প্রভু যীশুকেও। শহরের ছোটো ছোটো অন্ধকার গলি পথ ছেড়ে প্রধান সড়কে শুধুই প্রভু যীশুকে স্মরণ করে আলোয় মোড়া চেনা পথঘাট যেনো বড়ো বেশি অচেনা হয়ে গেছে আমার কাছে।
আর হাজার হাজার মানুষের ভীড়। সেই পথ ঘাট পেরিয়ে শুধুই জনস্রোতে মিশে যাওয়া, ভেসে যাওয়া, গা এলিয়ে দেওয়া যে যার মতো করেই। আর নিজের মুঠো ফোনে একটু নিজেকে হাসিমুখে বন্দী করা বুকের মাঝের কষ্টকে, যন্ত্রণাকে লুকিয়ে রেখে চুপটি করে। ঠিক যেভাবে প্রভু যীশুও বন্দী হয়েছিলেন হাসিমুখেই কারাগারে। সত্যিই যীশুর প্রেমে মেতে ওঠা। যেনো কৃষ্ণ প্রেমের চাইতেও বেশি প্রেমের পরশ পাওয়া। বাঙালির এই সদ্য গজিয়ে ওঠা বছর শেষের যীশু প্রেম দেখে বেশ অবাক হলাম আমিও। প্রায় পাঁচশো বছর আগের নিমাই এর প্রেমও কেমন যেনো অনুজ্বল হয়ে গেছে এই যীশু প্রেমের কাছেও। আসলে বোধহয় আমরা হুজুগে মেতে উঠতে বড়ই ভালবাসি।
এই গঙ্গার তীরের সেই কবেকার আপনমনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন সেন্ট ওলাফ গির্জা, যে গীর্জার বন্ধ ঘড়ি নিয়ে কম হৈচৈ হয়নি কদিন আগেই। সেই গির্জার শহরে তার উপস্থিতি নিয়ে এত মাতামাতি হয়নি আগে কখনও। সেই পোস্ট অফিসের অপরিসর রাস্তা, সেই শ্রীরামপুর স্টেশন এর নিচের গলাপোল এর ভীড়ে ঠাসা করিডোর পার হয়ে পশ্চিম রেলপাড় থেকে স্টেশন পার হয়ে ওপারে পৌঁছবার স্বল্প পরিসরে একটা ভয়ঙ্কর পরিকল্পনাহীন রাস্তায় শুধুই ভীড় আর ভীড় আর ধাক্কাধাক্কি, যানজট, আর প্রভু যীশুর কাছে যাওয়ার, একটু তাঁকে কাছে পাওয়ার, একটু তাঁকে দেখার অদম্য বাসনা সাধারন মানুষের। যে জনস্রোতের ধাক্কায় বেসামাল হয়েও আমিও নেমে পড়লাম সেই চেনা পথে অচেনা মানুষের ভীড়ে আপন মনে আপন ছন্দে।
যে ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ধাক্কা খেতে হয়, মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে হয় তিন চাকার টোটোর সাথে, দু চাকার মোটর সাইকেল এর সাথে, যে যার মতো করেই এগিয়ে যেতে চায় দ্রুত গতিতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে পড়েছে নানা দোকানপাট, আর শুধুই ভীড় আর ভীড়। যে যেদিকে পারছে যেভাবে পারছে এগিয়ে চলা। আমিও এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। ট্র্যাফিক জ্যামে, দিশাহীনভাবে পুলিশের সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কেমন হাবুডুবু খেলাম আমিও। কোনোভাবেই প্রভু যীশুর সামনে যেতে পারলাম না আমিও। এই ভীড়ের মাঝে লক্ষ্য করা গেলো না শহরের কোনো শান্তি রক্ষাকারী বাহিনীকেও। লক্ষ্য করা গেলোনা সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা করে এই হুজুগে মেতে ওঠা ভীড়কে চার্চের কাছে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করা পুলিশের ভূমিকা। আসলে মা মাটি মানুষের আমলে পুলিশ বড়ো বেশি ব্যস্ত হয়ে আছেন যীশু খ্রীষ্টের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে। বন্দুকের নল তো আর ক্ষমতার উৎস নয়। ক্ষমতার উৎস শুধুই প্রেম আর ভালোবাসা আর হরিনাম সংকীর্তন।
কোনও ভাবে আমি গুঁতো খেয়ে, টোটো আর দু চাকার আর মোটর সাইকেলের দাপটে ত্রস্ত শহরে ভয়ে ভয়ে হেঁটে চলার চেষ্টা করলাম আমিও একটু একটু করে সামনের দিকে। সত্যিই অসাধারণ এই যীশুময় শহরে প্রেমের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে আমার মনে হলো ভাগ্যিস আমিও এসেছিলাম এই চেনা শহরে নিজের চাষাভুসো পোষাক ছেড়ে একটু সাহেবসুবোর বেশ ধরে যীশুকে দেখতে।
এই ঘাস ফুলের গন্ধ মাখা শহরে, পঞ্চানন কর্মকারের সেই ছাপার অক্ষর, আর হরফ তৈরীর এই ইতিহাসের খটখট চেনা শব্দের শহরে, সেই শহীদ গোপীনাথ এর শহরে, সেই উইলিয়াম কেরির প্রাণের শহরে, সেই শ্রীরামপুরের গোস্বামীদের রাজবাড়ীর ইতিহাসের গন্ধমাখা শহরে, সেই মহেশের জগন্নাথ দেবের প্রেমের শহরে, সেই রামমোহনের শহরে, যে শহরে আজ বড়ো বেশি আলো, যে শহরে আজ বড়ো বেশি উজ্জ্বলতা, যে শহরে আজ বড়ো বেশি হৈ হুল্লোড়, চিৎকার আর গানের জলসার সুরে বেসামাল সেই শহর। যে শহরের নানা জাতের, নানা ধরনের মানুষ আজ বড়ো বেশি যেনো যীশুময় হয়ে গেছে।
সত্যিই বেশ অবাক হলাম আমিও। এমন যীশু খ্রীষ্টের প্রতি প্রেম ভালোবাসা তো আগে কখনও চোখে পড়ে নি আমার। ভীড় ঠেলে, উজ্জ্বল আলোর স্পর্শ গায়ে মেখে আনন্দে বেঁচে থাকার চেষ্টা করলাম আমিও। হারিয়ে গেলাম আমার চেনা শহরের অচেনা উজ্জ্বল আলোর পথে। যে পথের ধারে অপেক্ষা করছেন প্রভু যীশু স্বয়ং হাসিমুখে। সবাইকে ভালোবেসে হাজার দোষ অপরাধকে হাসি মুখে ক্ষমা করে দেবার বার্তা নিয়ে।
চেনা শহরে অচেনার ভীড়ে আমি - অভিজিৎ বসু।
পঁচিশে ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি নিজস্ব সংগ্রহ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন