কিছু কিছু মানুষ জীবনে এমন ভাবেই জড়িয়ে থাকেন যাদের সাথে হয়তো রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই। তবুও যেনো সেই মানুষটা আমাদের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকেন সমুদ্রের সফেন তরঙ্গের ঢেউ এর উচ্ছল জল তরঙ্গের মতই। যে তরঙ্গকে অস্বীকার করা যায়না কোনোভাবেই কোনও সময়। সারা জীবন ধরেই এই ধরনের মানুষগুলো কেমন হেসে খেলে আর ঠাট্টা করে আনন্দে বিন্দাস জীবন কাটিয়ে দেন। নিজের কোনোও হিসেব নিকেশ না করেই। কেমন নির্মোহ হয়ে অনায়াসে কাটিয়ে দেন তাঁর নিজের জীবনটা।
আজ সাদা জীবনের কালো কথায় সেই আমাদের সবার প্রিয় দুর্গাপুরের ভবুদার কথা। বড়দের কাছে ভবুদা আর ছোটদের খুব প্রিয় ভবুদাদু। হাজারও মানুষের ভীড়ে চরিত্রের মাঝে অন্য ধরনের এক মানুষ। যাঁর সাথে আমার আলাপ হলো আমার বিয়ের সময় শ্রীরামপুরে সেই মুখার্জী পাড়ার ভাড়া করা বিয়ে বাড়িতে একান্ত আপন ভবনে। দেখলাম তিনি রূপার শ্বশুরবাড়ি দুর্গাপুর এর লোক হলেও সবকিছুই সামলে নিচ্ছেন তিনি নিজের মতো করেই আপনজন হয়ে। এই বাড়ী ওই বাড়ী বা এই তরফ ওই তরফ এর কোনো বালাই নেই তাঁর মধ্য। শুধু একটাই কথা তাঁর মুখে কোনও চিন্তা নেই আমি সব দেখে দিচ্ছি, আপনাদের ভাবতে হবে না কিছুই। সে কতজন খেতে বসলো তার হিসেব করা। কার কি লাগবে তার দেখভাল করা। সব যেনো তাঁর নখ দর্পণে। আমি বেশ নতুন জামাই হলেও কেমন অবাক হয়ে দেখলাম তাঁকে।
ধীরে ধীরে কেমন যেন কাছের মানুষ হয়ে গেলেন তিনি নিজেই। আমাদের নতুন ফ্ল্যাট কেনা হলো শ্রীরামপুরে। লাইট কিনতে হবে ভবুদা হাজির। বললেন সোমা, অভিজিৎ কোনো চিন্তা নেই আমি আছি সব কিনে দেবো আমি। তারপর আমরা দুজন মিলে এজরা স্ট্রীট এর লাইট এর দোকানে ঘুরে ঘুরে লাইট, তার, এমসিপি, কলিং বেল সব কিনলাম। সব দোকানে গিয়ে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। বললেন আমাদের জামাই হয়। ভালো জিনিস দেবে আর বেশি দাম নেওয়া যাবে না কিন্তু কিছুতেই। সারাদিন ঘুরে জিনিস কিনে হাওড়াতে নিজের বাড়ী ফিরে গেলেন তিনি সাঁতরাগাছিতে। আমি মালপত্র নিয়ে ফিরে এলাম শ্রীরামপুরের ফ্ল্যাটে।
আসলে এনারা বোধহয় এমনই হয় যে কোনো ভাবেই যে কোনো কাজেই ঝাঁপিয়ে পড়েন কোনও আগুপিছু না ভেবেই। আর তাই নিজের জীবনটাও এইভাবেই কাটিয়ে দিলেন তিনি হাসি মুখে। শুধু একটাই চাহিদা তাঁর একটু খেতে ভালোবাসেন তিনি। সুন্দর পরিপাটি করে তাঁর খাওয়া দেখলে ভালো লাগবে বেশ। আর রসিক মানুষ তিনি। তাঁকে খাইয়ে আনন্দ লাগে। কিন্তু এই খাওয়া নিয়েই তো কত বারণ করা আর বকা ঝকা করা তাঁকে। কিন্তু এক রয়ে গেলেন সারা জীবন। এক সময় বেশ সুপুরুষ ছিলেন তিনি। বয়স হলেও সেই সুন্দর চেহারার কিছুটা ভাঙন হলেও তার আগের কম বয়সের চেহারার আভাস পাওয়া যায় এখনও সেটা তাঁকে দেখলে বোঝা যায়।
কিছুদিন আগেই শুনলাম অসুস্থ হলেন তিনি। হাওড়া জেলা হাসপাতালে তিনি ভর্তি হলেন। সকালে কদিন গুড মর্নিং আসছে না দেখে কি হলো বলে আমি রূপা কে ফোনে জিজ্ঞাসা করলাম। ওর উত্তর শরীর ভালো নেই ভবুদার। হাওড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে চিকিৎসা চলছে। প্রতিদিন সকাল বেলায় গুড মর্নিং দেবেন তিনি নিয়ম করেই । এটা তাঁর অভ্যাস প্রতি দিনের। আর মাঝে মাঝেই হঠাৎ করেই তাঁর ফোন চলে আসে আমার কাছে। অভিজিৎ কেমন আছো। কাজল বোন মানে আমার মেয়ে বুটা কেমন আছে। আর সোমার শরীর ঠিক তো। এইভাবেই সবার কথা জিজ্ঞাসা করা তাঁর স্বভাব। যে জিজ্ঞাসা আত্মীয় স্বজন পরিজনরাও কেউ করে না আজকাল খুব একটা। একটা অন্য ঘরানার মানুষ যেনো ভবু দা।
যা আমায় বেশ আলাদা একটা অনুভুতি দেয়। এই স্বার্থ সঙ্কুল পৃথিবীতে তাহলে এমন কিছু গুটিকয় মানুষ আছেন এখনও যাঁরা এইভাবেই হাসিমুখেই বেঁচে থাকেন। শুধুই নিজের জন্য নয় অন্যর জন্য। আর এই মানুষটার কথা আজ রাতদুপুরে আমার মনে হলো। তাই লিখে ফেললাম। অনেকদিন কথা বলা হয়নি। ফোন করব একদিন।
সত্যিই আজকাল এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। আর কমে যাওয়ার মাঝে এখনও হাসিমুখেই সকালে ঘুম থেকে উঠেই গুড মর্নিং দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি আমাদের আর মাঝে মাঝেই ভুল করে কল করে ফেলছেন তিনি। আর খবর নিচ্ছেন। আজকাল কে আর কার খবর নেয় বলুনতো এই বাজারে। তবু তো নিজের মতো করে তিনি খবর নেন আমাদের। সত্যিই ভালো থাকবেন আপনি সবসময় ভবু দাদু । আর এইভাবেই ছাতার মতো আগলে রাখবেন আপনি আমাদের সবাইকে। শুভ রাত্রি।
আমাদের সবার ভবু দাদু - অভিজিৎ বসু।
দশ ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন