সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মেলার মাঠে বিসর্জনের সুর

দেখতে দেখতে মেলা শেষের পথে। মাঝে আর মাত্র একটি দিন। এই সেদিন কত আনন্দ আর বাঁধ ভাঙা উচ্ছাস। কত অপেক্ষা। কত আগ্রহ আর আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার কল্পনা করে মেতে ওঠা। প্রাণের মেলা এই পৌষমেলাকে কেন্দ্র করে। আর আজ মেলা শেষের একদিন আগেই মেলার মাঠে বার বার মাইকে ঘোষণা, কাল ২৮ শে ডিসেম্বর মেলার শেষ দিন। ঠিক রাত বারোটায় মেলা শেষ হয়ে যাবে। পৌষ মেলা ২০২৪ এর মেলা শেষ হবে। দর্শকদের জন্য সব গেট বন্ধ হয়ে যাবে মেলার মাঠে ঠিক রাত বারোটার আগেই। যাঁরা বিক্রেতা তারা রাত এর মধ্যেই সব নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবেন, স্টল খালি করে দেবেন আপনারা। 


মেলার মাঠে দাঁড়িয়ে ঘুরতে থাকা উজ্জ্বল সেই নাগর দোলাও কেমন যেনো থমকে থেমে গেলো এই মেলা শেষের ঘোষণা শুনে। হাজার ভীড়ের মাঝে কেমন যেনো মন খারাপের বিষাদ সুর ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে এদিক ওদিক। মাইকে এই স্লোগান শুনেই কেমন যেনো মন খারাপ হয়ে গেলো আমার নিজেরও একটু। আবার একটি বছরের প্রতীক্ষা। আবার এক বছরের পর এই মিলন মেলা শুরু হবে এই বিশ্বকবি শান্তিনিকেতনে। আবার সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে মেলার মাঠে ফিরে পাওয়া। আবার ফিরে পাওয়া মেলার কুয়াশা ঘেরা মাঠে ডিসেম্বর এর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডাকে যা এইবার পাওয়াই গেলো না একদমই ।

সত্যিই কতকিছুর জন্যে যে আবার একটি বছরের প্রতীক্ষা করতে হবে ভাবলেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায় আমার নিজেরও। সত্যিই এই প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির মাঝে। কর্মহীন জীবন আর ছন্দহীন গতিহীন এলেবেলে এলোমেলো বিন্দাস জীবনের মাঝে এই কটা দিন বেশ কেটে গেলো কিন্তু আমার। ভাপা পিঠার সাদা ধোঁয়ার গন্ধ মেখে আর মেলার ভীড়ের ধুলোর আস্তরণ গায়ে মেখে হাসতে হাসতেই কাটিয়ে দিলাম আমি এই কটা দিন। একদম কপর্দকশূন্য হয়েই হাসি মুখে বিন্দাস এলোমেলো এলেবেলে আমার ভাবনাহীন জীবন নিয়ে। শুধু মানুষকে দেখে, জীবনকে দেখে, আর মেলার ভীড়ের ধুলোর আস্তরণ গায়ে মেখে চেটেপুটে আনন্দকে উপভোগ করা মানুষগুলোকে দেখে। আর ওই ছাই ভস্ম গায়ে মাখা হাসি মুখে সবাইকে আশীর্বাদ করা সাধুকে দেখে। যে কেমন নির্বিকার হয়ে বসে আছে মেলার মাঠে আপনমনে। জগৎ সংসারকে ভুলে। 

বীরভূম জেলার এই প্রান্তিক গ্রামের মেঠো মানুষ এর ভীড় বেশি এই পৌষের মেলায়। শহুরে জীবনের থেকে গ্রামের মেঠো মানুষ মেঠো পথ পেরিয়ে কেমন করে ছুটে আসে তারা এই মেলার ভীড়ে একটু গা এলিয়ে দিয়ে। বেতের বোনা ধামা কুলোর সোঁদা গন্ধের টানে। পায়ে হেঁটে, কেউ সেই তিন চাকার মোটর যান চেপে। সত্যিই বিশ্বকবির এই প্রাণের মেলা যতই ঝাঁ চকচকে হয়ে যাক। যতই আধুনিকা হোক। মেঠো পথ, মেঠো গন্ধ মাখা মানুষ, তাদের এই মেলার মাঠে মাটিতে বসে পরে জিনিস বিক্রি করে দু পয়সা রোজগার করা এটাই তো সেই পুরোনো বুলবুলভাজা গান এর মেলার আসল চিত্র আর আসল উদ্দেশ্য। আর যার টানে ছুটে আসে হাজার হাজার মানুষ। কেউ দশ টাকার জিনিস কিনে খুশি হয়ে মহানন্দে বাড়ী ফিরে যায়। আবার কেউ অল্প টাকার জিনিস বিক্রি করেই খুশি মনে ঘরে ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গোনে। সত্যিই ক্রেতা আর বিক্রেতার এই অমলিন মেঠো সম্পর্কের মিলন মেলা তো এই শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলাই। যা বোধহয় শহুরে মেলায় এমন দেখা পাওয়া ভার। 

 সরকারী স্টলের সামনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একদৃষ্টিতে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকা মূর্তি দেখে মনে হলো তিনিও বোধহয় এই বীরভূমের প্রান্তিক জন গোষ্ঠীর গ্রামের মানুষদের কথা ভেবেই এমন আশ্রম, এমন শান্তিনিকেতন তৈরি করেছিলেন। যাতে এই সব মানুষেরা একটু নিজেদের হাতে তৈরি জিনিস বিক্রি করে দু পয়সা রোজগার করে। হয়তো সেই মেলার আয়োজন মেলার সাজসজ্জা, মেলার চাকচিক্য অনেক বদলে গেছে। একদিনের সেই মেলা আজ কেমন দেখতে দেখতে ছয় দিনে এসে হাজির হয়েছে।

 মেলার মাঠে রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছবি লাগানো স্টল দেখে বোঝা যায় এই মেলা এখন আর শুধু ক্রেতা আর বিক্রেতার নয়। মেলা এখন রাজনীতির ময়দানে ঘুরে বেড়ানো মানুষদের জনসংযোগের হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহার হয়। যা হয়ত আজ থেকে একশো বছর আগের মেলায় কোনোদিন দেখা যায়নি এমন সাজসজ্জা করে। তবু সবকিছুকে ছাপিয়ে দিয়ে মেলা মাঠে রাত বাড়ছে আর ঘোষনা হচ্ছে মেলা শেষ হবে আর মাত্র একদিন বাকি। মেলার মাঠে ঘুরে বেড়ানো ক্রেতা আর বিক্রেতার সবার মন খারাপ। বেচাকেনা যাই হোক পৌষের গন্ধ মাখা এই মেলার জন্য যে আবার একটি বছরের প্রতীক্ষা। 

মেলার মাঠে বিসর্জনের সুর - অভিজিৎ বসু।
আটাশ ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি নিজস্ব মোবাইল ফোনে তোলা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ইটিভির পিনাকপাণি ঘোষ

কিছু মানুষ কত কাছে থেকেও পাশাপাশি এক জায়গায় বাস করেও একসাথে একসময় কাজ করেও যে কত দূরে রয়ে যান নিজের হাসিমুখ নিয়ে আর সেই চেনা ছন্দ নিয়ে সত্যিই বেশ ভালো মজার ব্যাপার কিন্তু এটা জীবনের মেঠো পথে। সেই ইটিভির বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে ঘুরে ঘুরে স্ট্রীট ফুডের ছবি তোলা আর নানা খবর করে খাওয়া দাওয়ার এপিসোড করে একসময়ে বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে যাওয়া ইটিভি নিউজে। আর আমাদের জেলায় বসে সেইসব হাঁ করে দেখা আর কেমন মনের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হওয়া। একেই বলে কলকাতার রাজপথের সাংবাদিক বলে কথা।  সেই যে বার রাষ্ট্রপতি এলেন জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে সেই অনুষ্ঠানের বিশেষ কার্ড জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করা ইটিভির চাকরি করার সুবাদে। কোনো রকমে সেই কার্ড জোগাড় করে এনে দেওয়া তাঁকে আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সেই একদিন দুপুর বেলায় খুব সম্ভবত করোনা শেষ পর্বে বালিঘাট স্টেশন থেকে অফিস যাওয়ার সময় এসি পঞ্চাশ এর বাস এর ভিতরে দেখা হওয়ায় কত গল্প করা দুজন মিলে পুরনো দিনের। আবার উত্তরপাড়ার সেই বিখ্যাত চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে হাসি মুখে দেখা হয়ে যাওয়া রাতের বেলায় কাঁঠালবা...

আমাদের সবার মৃনাল দা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক বাবা আর ছেলের লড়াই এর গভীর গোপন কাহিনী। এই সাংবাদিকতার পেশায় এসে কত লড়াই, কত অসম যুদ্ধ, করে যে কেউ সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে হাসি মুখে কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে। এমন করে কেউ টিকে থাকার চেষ্টা করেন সেটা বোধহয় আমার জানা হয়ে উঠত না কিছুতেই। যদি না এই পেশায় আমি গা ভাসাতাম এমন করে। জীবনের এই নানা টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভেসে ওঠে এই রাতের অন্ধকারে আচমকা আমার মনের মাঝে। আর আমি চমকে উঠি কেমন করে তাদের সেই কোলাজ দেখে।  এমন এক চরিত্র, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়ে কেমন আলগোছে, হাসিমুখে, নির্মোহ ভাবে, শুধু নিজের কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো সে শুধুই আকাশ পানে তাকিয়ে। যে নীল আকাশের গা ঘেঁষে উড়ে যাওয়া সাদা বকের ডানায় লেগে থাকে মেঘের হালকা টুকরো। একদম যেনো সিনেমার পর্দার হিরোর মতোই। দেখে বোঝার উপায় নেই একদম। পেটে খাবার না থাকলেও মুখের হাসিটা অমলিন হয়েই বেঁচে আছে আজও এতোদিন পরেও। আর সেই বিখ্যাত সাদা পাকা নাসিরউদ্দিন স্টাইলের দাড়ি, কালো চুল, আর সব সময় ধোপদুরস্ত ফিটফাট একজন মানুষ। রাত নটা বাজলেই যাকে শ্রীরামপুরে...

শপিং মলের উদ্বোধনে সিঙ্গুর আন্দোলনের দাপুটে মন্ত্রী

নালিকুল স্টেশন বাজারে একটি শপিং মলের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বেচারাম মান্না হাজির। একসময় যাঁর অন্দোলনের ঠেলায় পড়ে দৌড়ে একপ্রকার পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা কোম্পানিকে। যে আন্দোলনের দগদগে ঘা আর সেই স্মৃতি ধীরে ধীরে আজ প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের কাছ থেকে। আজ সেই চাষার ঘরের মানুষ না হলেও সেই কৃষক আর শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন সেই মানুষটাকেই কেমন যেন আজ শপিং মলের উদ্বোধনে দেখে বেশ ভালই লাগলো আমার।  একদম নালিকুল স্টেশনের কাছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল। দোকানে সাজানো জিনিস পত্র। আর সেখানেই আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বেচারাম মান্না। একদম কেমন একটু আমার অচেনা লাগলো যেন। সেই মুড়ি খেয়ে আলুর তরকারি বা শশা খেয়ে আন্দোলন শুরু করা জমি আন্দোলন এর অন্যতম পথিকৃৎ নেতা আজ এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তাহলে টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে যে জমি দখল নিয়ে আন্দোলন সেই আন্দোলন এর মধ্যে ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। যদিও সেখানেও সেই সময়ের শাসকদলের কর্মসংস্থানের যুক্তি।তবে এই নতুন শপিং মলের উদ্বোধনে তো আর ...

ভীড়ের মাঝে একা

জীবন জুড়ে শুধুই ভীড় আর ভীড়। নানা ধরনের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় মানুষের গন্ধে, বর্ণে , স্বাদের ভীড়ে আমি একদম একা হয়ে যেতে চাই। যে ভীড় উপচে পড়া রাস্তায় শুধুই হেমন্তের ভোরে শিশিরের ফিসফিস শব্দ, পাখির কিচির মিচির আওয়াজ,ধানসিড়ি ওই নদীটির তীর ধরে ঘুঘুর আকুল মন কেমন করা ডাক, উদাসী শালিকের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া ওই হেমন্তের হলুদ ধানের মাঠ এর পাশ দিয়ে, হলুদ বসন্ত বৌরীর সেই আমলকীর গাছের পাতায়,আড়ালে আবডালে বসে কেমন যেন আমায় দেখে লজ্জা পাওয়া, আর তারপর চোখ নামিয়ে হঠাৎ করেই তার উড়ে চলে যাওয়া। আর মেঘের কোল ঘেঁষে সেই সাদা বকের, বুনো হাঁসের, আর সেই পানকৌড়ির জলে ভেজা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া আকাশ জুড়ে। সত্যিই ওরাও যে ভিড়ের মাঝেই বড়ো একা। একা একাই ওদের যে এই বেঁচে থাকা। কেমন নিপাট হৈ চৈ হুল্লোড়হীন একটা জীবন নিয়ে বেশ মজা করে, আনন্দ করে। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে রাস্তার একপাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা ওই সাদা কালো ভুলো নামের কুকুরের। যে অন্তত এই সব মানুষদের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একটু যেনো আলাদা , একটু যেনো অন্য রকমের। একটু একা একাই যেনো ওর এই আলগোছে জীবন কাটিয়...

গৌড় প্রাঙ্গণে আনন্দবাজার

গৌরপ্রাঙ্গনে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের আনন্দের মেলা আনন্দবাজার। মহালয়ার ভোরবেলায় ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের মন কেমন করা সুরে মেতে উঠলো শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গণ। প্রতি বছরের মতো এই বছরও যে হবে আনন্দমেলা আনন্দবাজার। হ্যাঁ সত্যিই যেনো আনন্দের এই হাটে বেচাকেনার পসরা নিয়ে একদিনের জন্য বসে পড়া মন প্রাণ খুলে হৈ হুল্লোড় করে। এই মেলা শুরু হয় 1915 সালের 15 এপ্রিল নববর্ষের দিনে। কিন্তু আগে এই মেলাকে একসময় বলা হতো বৌঠাকুরাণীর হাট। সেই সময় আশ্রমের মহিলারা নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসতেন। মেলার আয়োজন করতেন তারা। আনন্দ করে বেচাকেনা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় একবার গরমের ছুটির আগে এমন মেলা নাকি হয়েছিল। যার নাম ছিল আনন্দবাজার। পরে এই মেলার নামে হয়ে যায় আনন্দমেলা। সত্যিই আনন্দের এই মিলন মেলা।  প্রথমদিকে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মেলা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বভারতীর সব বিভাগের পড়ুয়ারা এই মেলায় যোগদান করে। এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের বেচা কেনার লাভের টাকার কিছু অংশ জমা পরে বিশ্বভারতীর সেবা বিভাগে। সেখান থেকে এ...