শীত পড়লেই কেমন চারিদিকে শীতবস্ত্র বিতরণ এর খুব ধুম পড়ে যায়। এই তালিকায় রাজনীতির হাসি মুখের হাত জোড় করা নেতা তো এতদিন ধরে ছিলই মাঠে ময়দানে। বর্তমানে মা মাটির আর মানুষের পাশে দাঁড়ানো পুলিশও যোগ দিয়েছে এই কম্বল বিতরণের তালিকায় নতুন করে। আর এছাড়া বিভিন্ন সোশ্যাল কাজ করা নানা সংস্থা তারা তো আছেই বহুদিন ধরেই।
বিজ্ঞাপনী ব্যানার ঝুলিয়ে কম্বল বিতরণের দিন ঘোষণা করা। রাস্তার মোড়ে টোটো করে ঘুরতে ঘুরতে ভাঙা চোরা গ্রামের রাস্তা তো আর নেই বলা যাবে না সেটা একদম। মসৃণ তেল চকচকে রাস্তার ওপর দিয়ে যেতে যেতে গলা কাঁপিয়ে বলা কম্বল বিতরণ করবেন বিধায়ক বা নেতা বা মন্ত্রী বেশ জোর গলায় ভোর বেলায় নতুন গলা সাধার মতো করে। তিন চাকার চেনা রতন এর টোটো তখন যেনো পঙ্খিরাজ এর মতই উড়ছে গ্রামের তেল চকচকে মসৃণ রাস্তায়। ঠিক যেনো মহাভারতের সেই পুরোনো আমলের রথ এর মতই। আর পাড়ার চেনা রতন যেনো তখন সবার কাছেই দেবদূত।
আর সেটা শুনেই রাস্তার পাশের দুখী মাসীর গরম কড়ার ওপর খুন্তি আটকে যায় পুকুর থেকে তুলে আনা শাক ভাজতে ভাজতে। গরম কাঠের আঁচে দুখীর মুখে তখন শীতের শুকনো বলিরেখার আঁকাবাঁকা সর্পিল দাগ ঠিক যেনো শীতের জঙ্গলে শুকনো নদীর মতই আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলা দুখীর। যে নদীপথ ধরে পার হয় কবিতার লাইনের সেই নাম না জানা দু চাকার গাড়ি।
অবশেষে সেই দিন আসে। শীত বস্ত্র বিতরন এর বিশেষ দিন। দুঃখ কষ্ট সহ্য করে ঠাণ্ডায় কাতর হয়ে পৌষের ঠাণ্ডা গায়ে মেখে বেঁচে থাকার চেষ্টা করার একটা শেষের দিন। আর সেই দিন সকাল থেকেই ঘন ঘন মাইকে ঘোষণা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মধ্যে এসে হাজির হবেন আমাদের সবার প্রিয় বিধায়ক, নেতা বা মন্ত্রী যিনি নিজের হাতে সবার হাতে একটু গরম তুলে দেবেন। কিম্বা একটু ঝলমলে রোদ্দুর তুলে দেবেন হাসিমুখে। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন।
সত্যিই অসাধারণ তাই না ঠাণ্ডায় জুবুথুবু হয়ে যাওয়া গুটিয়ে যাওয়া ওই মানুষগুলোর হাতে একটু উষ্ণতা তুলে দেওয়া, একটু রোদ্দুর তুলে দেওয়া। আচ্ছা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই বিধু, দুখী, সুকুমারী, মানদা আর সেই গ্রামের গাছ পাথরহীন বয়স্ক নামহীন বৃদ্ধ এরা নিশ্চই একটু উষ্ণতার সেই বিখ্যাত লেখার কথা জানতেই পারেনি এত দিন এত বছরেও। যে শীতার্ত জীবনে উষ্ণতার খোঁজে একটু বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যায় নিজের উদ্যোগে। লাইনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে রোদ্দুর নেওয়া নয়। নিজের হাতে রোদ্দুরের সন্ধান পাওয়া।
গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায় ওরা। মাঠের মাঝে বসে পড়া ওরা কেমন গায়ে একরত্তি কাপড় জড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সাদা গাড়ির কালো কাঁচ নেমে যায়। সাদা পোশাকে, নরম জুতোয় পা দিয়ে হেঁটে আসেন মন্ত্রী, বিধায়ক বা একটু উষ্ণতার সন্ধান দেওয়া হাসি মুখের ভিন গ্রহের সেই মানুষটি। হাততালি পড়ে। হাতে হাতে গরম বিলি হয়। উষ্ণতা বিলি হয়। রোদ্দুর বিলি হয়। শুকনো বলিরেখা টানা মুখে কেমন রোদ্দুরের লুটোপুটি। যা দেখে আমার মনটা ভরে যায়। ওদের হাড় পাঁজর বের হওয়া বুকের মাঝে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া। একটু রোদ্দুরের লুটোপুটি। একটু গরম ওমের হাতছানি। দুখীর মুখে কেমন রোদ্দুরের মায়াভরা ছোঁয়া।
কেমন যেনো থমকে যাই আমি। এক চিলতে দুখীর ভাঙা ঘরে আজ রোদ্দুরের লুটোপুটি। বিধুর ফোকলা মুখে অনাবিল আনন্দের হাসি। মনে মনে ভাবি ভাগ্যিস পৌষ এর কাছাকাছি সেই কি এক মন ভালো করা গান ছিল না পুরোনো দিনের। সন্ধ্যা নামে গ্রামে। মাঠ ফাঁকা হয়। সবাই ঘরে ফিরে যায়। মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে কুয়াশা মাখা শীতার্ত গাছ। একটু ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায়, একটু রোদ্দুর এর অপেক্ষায়। শীতের হিমের পরশ গায়ে মেখে অপেক্ষা করে সে একটু উষ্ণতার জন্য।
একটু উষ্ণতার জন্য - অভিজিৎ বসু।
বিশে ডিসেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন