এখন তাঁর বয়স চুরাশি বছর। এই বয়সেও ঘরে থাকতে মন টেকেনা তাঁর কিছুতেই। অবসর জীবনে তিনি কিছুতেই ঘরের মাঝে বন্দী করে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। তাঁর ছেলেরা বাবাকে ঘর থেকে বেরোতে মানা করলেও তিনি সেই কথা শোনেননা একদম। আর তাই সকাল হলেই কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়া তাঁর বরাবরের অভ্যাস।
শ্রীরামপুর স্টেশনের পাশেই পশ্চিম রেলপাড়ে তাঁর বাড়ী। খবরের নেশা আর ছবির নেশায় সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন তিনি। ছবি তাঁর ধ্যান জ্ঞান আর প্রেম। যাঁর টানে আজও তিনি প্রায় নবব্বই বছর বয়সের দোরগোড়ায় পৌঁছেও কেমন করে যেন পা টেনে টেনে নবান্নে পৌঁছে যান ট্রেন ধরে আর বাস ধরে। মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে খুব ভালোবাসেন, পছন্দ করেন।
বহু ক্যামেরাম্যানকে তিনি নিজের হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন। ক্যামেরা চালানো শিখিয়েছেন। আর তাঁর হাতে কাজ শিখে অনেকেই আজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই শ্যামল মৈত্র একসময় এই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ছবি তুলতে ছুটে গেছেন। প্রাণ হাতে করে ছবি তুলেছেন যুদ্ধের। কোনোভাবে বেঁচে ফিরে এসেছেন যশোর থেকে। যখন বোমা পড়ছে, ফায়ারিং হচ্ছে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করে। আসলে ছবির নেশায় তখন তাঁর নিজের প্রাণের কথা মনে পড়েনি একদম। শুধু এডভেঞ্চার আর ছবির নেশায় মগ্ন হয়ে কাজ করেছেন কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে। সেই অভিজ্ঞতার কথাই শোনালেন তিনি শ্রীরামপুরের বাড়িতে বসে।
অফিসের গাড়ি করে যেতেন যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে আর ছবি তুলতে। অফিসের গাড়ি করে যেতেন তাঁরা ঝিকরগাছা বলে একটি জায়গায় যেটি ছিল।বাংলাদেশ এর মধ্যে অবস্থিত। সেখানে সারা বিশ্বের প্রেস ফটোগ্রাফাররা হাজির হতেন ভীড় করতেন যুদ্ধের ছবি করবেন বলে। মার্ক টুলির কথাও বলেন তিনি যুদ্ধের ছবির স্মৃতি রোমন্থন করতে বসে। এই ভাবেই প্রায় একমাস ধরে যুদ্ধের খবর করতে ছবি করতে হাজির হতেন তিনি। প্রতিদিন নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে আসতেন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল তাঁরা দুই জন রিপোর্টার আর একজন প্রেস ফটোগ্রাফার মিলে ঠিক করলেন তাঁরা ভেতরে যাবেন বাংলাদেশের। কোনোভাবে সবার নজর এড়িয়ে তাঁরা তিন জন পৌঁছে গেলেন মুক্তি যোদ্ধাদের হাত ধরে যশোরে। ক্যান্টনমেন্টে সেখানে তখন এদিক ওদিক মৃতদেহ পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মাথার উপর দিয়ে সেল ছুঁড়ছে পাকিস্তানিরা ঘন ঘনও। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে । আর তার মাঝেই কোনো ভাবে প্রাণ হাতে করে খবর সংগ্রহ করে ছবি তুলে বর্ডারে ফিরে আসা। এইভাবেই সেই যুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করলেন শ্যামল মৈত্র শ্রীরামপুরে তাঁর ঘরে বসে।
আজ বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি দেখে তাঁর মনে হয় কেনো এমন হলো দেশটার। কি কারণ এই অবস্থার জন্য দায়ী কে। এই দেশকে তো ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন করতে সাহায্য করেছিলেন সেই সময়। মনে পড়ে যায় তাঁর সেই দিনের কথা, যুদ্ধের দিনের কথা তাঁর নিজের ঘরে বসে। মনে হয় এই বয়সেও তিনি ছুটে যান আবার ক্যামেরা কাঁধে।
সঙ্গী ক্যামেরা,ঘিরে রাখে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
-অভিজিৎ বসু
সতেরো ডিসেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য সৌগত রায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন