চুমু নিয়ে কিন্তু ইদানিং চিন্তার শেষ নেই। চুমু নিয়ে ভাবনারও শেষ নেই। চুমু নিয়ে আপত্তিরও শেষ নেই। চুমু নিয়ে মাতব্বরি বা দাদাগিরিরও কোনও শেষ নেই। চুমু নিয়ে সুখানুভূতির শেষ নেই। শুকনো ঠোঁটের চুমু নিয়ে হৃদয়ে অনুভূতির অনুরণন এরও শেষ নেই। আর এই চুমু নিয়েই এখন জোর আলোচনা,হৈ চৈ হুল্লোড় পড়ে গেছে চারিদিকে। প্রকাশ্যেই কালীঘাট মেট্রো প্লাটফর্মে একজন অপরজনকে চুমু খেয়ে নিয়েছে। আর তাতেই যেনো চারিদিকে গেলো গেলো রব পড়ে গেছে। রসাতলে গেলো মেট্রো স্টেশন। রসাতলে গেলো কলকাতা শহর। গঙ্গাজলে শুদ্ধ না করলে সেই স্থান আর শুদ্ধিকরণ হবে না কিছুতেই। একদম রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির মতোই শুদ্ধিকরণ অভিযান।
চুমু যে অন্ধকারেই খেতে হবে এমন দিব্যি তো কেউ দেয়নি বোধহয়। কে জানে এমন নিদান কি কোথাও লেখা আছে নাকি বেদ, পুরাণে। হয়তো পুরাকালে সেই রামায়ণ আর মহাভারতের যুগে চুমুর জন্ম অন্ধকারেই হয়েছিল কোনও একদিন হঠাৎ করেই আচমকা। সে তখন অনেক ছোট ছিল একদম শিশু ছিল। তাই সে হাঁটি হাঁটি পায়ে আলো আঁধারি পরিবেশে বেড়ে উঠেছিল, একটু একটু করে লজ্জা নিয়েই। দিনের আলোয় অভ্যস্ত ছিল না সে সেই সময়। আর তাই অন্ধকার পরিবেশেই স্বচ্ছন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে দিনযাপন করেই চলে যাচ্ছিল তার জীবন বেশ হাসিমুখেই।
কিন্তু দিন বদলে গেলো দ্রুত। বদলে গেলো অনেক কিছুই। বদলে গেলো ভালোবাসার স্পর্শ আর চুমুর সংজ্ঞাও। আচ্ছা চুমু মানে কি শুধুই দুটো ঠোঁটের স্পর্শ নাকি অন্য কিছু। একটি চুম্বন। কত সহজ, আবার কত জটিল! চুম্বন মানে তো কেবল এক ঠোঁটের সাথে অন্য ঠোঁটের স্পর্শ মাত্র নয়। চুম্বন মানে সাহস, প্রেম, বিদ্রোহ, আর কখনও কখনও, দুটো ঠোঁটকে সম্মতি-সহ একসঙ্গে নিয়ে এসে সমাজকে তুড়ি মেরে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া। সমাজের রক্তচক্ষু দেখানো ধ্বজাধারীদের বলা দেখো তোমরা।
যে সমাজ আমাদের কড়া নজরদারি করে দিন, রাত, দুপুর,সন্ধ্যা আর বিকেল বেলায়। পড়ন্ত বিকেলের লাল আভায় যখন মনে সাহস জাগে, প্রেম জাগে, মনে ভালোবাসার বান ডাকে তখনই তো দুটো মন, দুটো প্রাণ, দুটো ঠোঁট কাছে আসার ইচ্ছা অনুভব করে। সেই ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত নাকি সেই ইচ্ছাকে অবদমিত করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খিল এঁটে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা উচিত কে জানে।
এই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলা সমাজ বোধহয় বড্ড ব্যাকডেটেড গেঁয়ো হয়েই বেঁচে থাকতে চায়। আজীবন ছোট্ট শিশু হয়েই সে ঘুরে বেড়াতে চায় একটু লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে মায়ের আঁচলের তলায়। পশ্চিমী দুনিয়ার আদব কায়দাকে বেশ মনে ধরলেও। টপ করে শব্দ করে লাল শুকনো খটখটে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে সিক্ত করে দেওয়া কি সত্যিই অপরাধের কে জানে।
কে জানে এই রাতদুপুরে বুড়ো বয়সে চুমু নিয়ে বেশ চিন্তায় আছি কিন্তু আমিও। আমার আজ ঘুম আসছে না কিছুতেই। সেই কলেজ সেরে ঘরে ফেরার পথে গঙ্গার ধারে অন্ধকার আলো আঁধারি রাস্তায় একটু যেনো খোলা আকাশের নিচে এলোমেলো চুলের ঝাপটা,গরম নিঃশ্বাসের ওঠানামা, মাথার ওপর শুকতারার ফিক করে সেটা দেখে হেসে ফেলা, আর দুটো কবুতরের ঠোঁটের মিলন কি তাহলে ঠিক ছিল না, অবৈধ ছিল কে জানে। দূরে অন্ধকার জলে তখন আলো জ্বালিয়ে দাঁড় টেনে চলে যাওয়া মাঝির গলায় বাউন্ডুলে গান। মনের মাঝে ডুব দাও তুমি, ওগো আমার নাগর গো।
সত্যিই তো চুমু তো শুধুই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, আঁকড়ে ধরে, বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা নয়। মনের মাঝে ডুবে দিয়ে একে অপরের কাছে উন্মুক্ত হওয়া। এই উন্মুক্ততা এই ঘৃণা, লজ্জা আর ভয় কাটিয়ে কাছে আসা তো অপরাধের নয়। শুধু দুটো শরীর এর কাছে আসা নয়, দুটো মনের, দুটো প্রাণের, দুটো ধুকপুক করা হৃদয়ের কাছে আসা। তাহলে কেনো যে এত চিৎকার, হৈ চৈ হুল্লোড় পড়ে গেছে কে জানে।
এই কল্লোলিনী কলকাতা, হলুদ ট্যাক্সির হারানো ভালোবাসা মেখে বোধহয় একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। সেটা বোধহয় আমরা টেরও পাইনি। এই তো সমস্যার আসল জায়গা। কলকাতার ভদ্রলোক সমাজ মনে করে, তারা এই শহরের মন আর মস্তিষ্কের একমাত্র মালিক। তাদের অনুমোদন ছাড়া যদি কেউ কিছু করে, তবে সেটি অবশ্যই ‘অসভ্যতা’। আর ভালোবাসা? ওহো, সেটা তো তাদের নিয়ম মেনেই চলতে হবে।
কিন্তু সেই ভালোবাসা কি আর কারুর চোখ রাঙানো আর লাল, সবুজ, গেরুয়া নিয়ম মেনে চলতে জানে? যা নিজের ইচ্ছায় চলতে শেখেনি কোনোদিন কোনো সময় সে কিভাবে অন্যের নিয়ম মেনেই চলবে বাধ্য ছাত্রের মতো। আসলে এই দ্রুত বদলে যাওয়া শহরে সজোরে ধাক্কা মেরেছে এই দুটো মানুষ, দুটো মন, দুটো ধুকপুক করা হৃদয়। ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে তারা সংস্কৃতির পীঠস্থান এর এই শহরে। আর তাই বোধহয় এত গেলো গেলো রব।
'এই পাথুরে পাথর যুগে বলছি তোমায় চুমু খাও,
বড় শুকিয়ে যাচ্ছে সব, ঠোঁটে ঠোঁট আদরে ভেজাও'
একটি চুমু নিয়ে হৈ চৈ - অভিজিৎ বসু।
বাইশ ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক ও ইন্টারনেট।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন