আজ সাদা জীবনের কালো কথায় আমাদের সেই হুগলীর শিয়াখালার ভজা আর তরুণের গল্প। সেই সিপিএমের আমলে বিখ্যাত এক পুরোনো দিনের বিরোধী রাজনীতি করা জুটির গল্প। যে জুটি আজ ভেঙে গেছে অনেকদিন আগেই। ভজা আছে, কিন্তু তরুণ আর নেই আমাদের মাঝে। আসলে মাঝে মাঝেই এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো কেমন যেনো বুদবুদের মতোই ভেসে ওঠে আমার মনের মাঝে। মনে পড়ে যায় তাদের কথা। এরা তো আমাদের খবরের জীবনের মাঝে, নানা খবরের সুলুক সন্ধান দিয়ে রাজনীতির বৃত্তে কাটিয়ে দিতে দিতেই নিজেদের জীবনটা কাটিয়ে দিলো কেমন হাসতে হাসতেই।
রাজনীতির উত্থানের আর পতনের সাথে এদের জীবনের কোনো বদল হয়না কোনোদিন কোনো ভাবেই। কেমন যেন একটা আলগোছে একজনকে ভালোবেসে, বিশ্বাস করে, নিষ্ঠা মেনে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া। জীবনে কি পেলাম আর কি পেলাম না তার হিসেব নিকেশ না করেই। আসলে রাজনীতির মাঠে ময়দানে এমন মানুষ দ্রুত হারেই কমছে। তবু আজ হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো আমার ভজা আর তরুণের সেই ফেলে আসা দিনের কথা।
সেই হুগলী জেলার বারুইপাড়া রেলগেট পার হয়ে একটু এগোলেই তারক কর্মকারের ইট ভাটা পার করে এগোলেই শিয়াখালার মোড়। সেখানে গেলেই মনে পড়ে যেতো তরুণ পান এর কথা। সেই হাসিখুশি ছেলেটা, চেহারা ঠিক আকবরদার ভাই যেনো, গলায় একটা মাফলার, মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে, গায়ে উইন চিটার, সারের দোকানে বসে থাকে সে। গোটা এলাকায় গ্রামে একাই কংগ্রেসের বা তৃণমূলের পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে হাসি মুখে। কিন্তু সিপিএমের দাপটে বিরোধী রাজনীতি তো করাই দায় সেই সময়। কখন যে কি কেস দিয়ে দেবে লাল পার্টির নেতারা কে জানে। ভয়ে আতঙ্কে থেকেও বিরোধী দলের পার্টি করা সেই আমলে কম কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয় কিন্তু।
কখনও দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দেবে, ভোট প্রচারে গেলে গাছে বেঁধে রাখতে পারে, গ্রামে জল, কল, ধোপা নাপিত সব বন্ধ করে দেওয়া এসবের তো শেষ নেই সেই সময় বাম আমলে। তবু সেই আমলে ঘাসের ওপর জোড়া ফুলের পতাকা নিয়ে তৃণমূলের ব্রিগেড বাহিনীর প্রথম কমরেড তো ছিল এরাই। যাঁরা আজও হয়তো কোনরকমে শিবরাত্রির সলতের মতোই আজও টিমটিম করছে দলের মিটিং মিছিলে এককোণে, সামনের সারিতে যে বড্ড ভীড়। আর আজকের ঝাঁ চকচকে ব্রিগেডে রাম্প এ হাঁটা তৃণমূল এর ঝকঝকে নেতারা তখন সব শুটেড আর বুটেড হয়ে গলায় ভারী চেহারার বিছেনড়ী হার গলায় দিয়ে ফর্সা মুখে আওয়াজ তুলছে জয় মা মাটি মানুষের জয়। সত্যিই অসাধারণ এই জীবনের স্লোগান।
আমি বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম সেই বিভাবসু মুখার্জী আর তরুণ পান এর কথা। এরা কি তৃণমূলের সেই যাঁরা প্রথম দিনের পুরোনো কমরেড সেই ভজার নাম যে কি করে বিভাবসু হলো কে জানে সেটা আমি জানিনা আজও। কিন্তু ওর এই নামটা মাঝে মাঝেই সেই দুর্গা পুজোর সময় পাতুল গ্রামের পুজোয় ভজার নাম বের হতো কাগজে দেখতাম। ইটিভিতে পুজো এলেই ভজা ফোন করতো আমায় শ্রীরামপুরের ইটিভির অফিসে। সেই টেলিফোন নম্বর হলো ২৬৫২৪০৯০, এই নম্বরে ফোন করেই মিলতো নানা খবর।
পূজো পরিক্রমায় ওদের গ্রামের পূজো যেনো দেখানো হয়। মিস করা যাবে না কোনও ভাবেই। সারা বছরে ভজার এই একটিই আবদার জেলার গুটিকয় খুব কম সংখ্যক রিপোর্টারদের কাছে। সে আনন্দবাজার পত্রিকা হোক বা ইটিভি বাংলা। বিনিময়ে গ্রামের ভালো ভালো খবর সে পয়সা খরচ করে ডায়াল করা ফোন ঘুরিয়ে সে দেবে আমাদের সারা বছর। আর গ্রামে ছবি তুলতে গেলে পেট ভরে খাওয়াতে ভোলে না ভজা এটা তার বরাবরের অভ্যাস। বিয়ে না করলেও সাংবাদিকদের খাতির যত্নের কসুর করেনি কোনোদিন।
আর যখনই আকবরদা ভজা আর তরুণকে শেওড়াফুলি থেকে যদি ফোনে বলতো শোন ভজা আর তরুণ আজ দিদি আসবে আরামবাগ যাবে দিদি। যাওয়ার পথে একটু থাকিস তোরা রাস্তায় যদি কিছু লাগে দিদির। ভজা আর তরুণ ঘরের মুড়ি আর তেলেভাজা আর জল নিয়ে কোনোদিন গাছের নারকেল নিয়ে তারা দুজন হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতো শিয়াখালার মোড়ে। কখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর গাড়ি আসবে সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনতো তারা দুজন ঘন্টার পরঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এখনকার মতো তো আর অবস্হা নয় তখন। হ্যাঁ, এই হলো ভজা আর তরুণ এর সিপিএমের বিরুদ্ধে নতুন তৃণমূলের দল করা দুই ক্যাডারের গল্প। যার মধ্যে একজন বেঁচে নেই আর অন্যজন বেঁচে থাকলেও কেমন মরার মতই বেঁচে আছে। তবু মুখের হাসি কমে নি এখনও।
এইভাবেই তো সেই তারা ঘরের পয়সা খরচ করে, টাকা খরচ করে দল করে গেছে তারা কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে। ভজা তো সারাজীবন বিয়েই করলো না দল করবে বলে। একবার ভোটে দাঁড়িয়েছিল সে কিন্তু পাশ করতে পারেনি সেই পরীক্ষায়। তারা কেউ কিছুই পাওয়ার আশায় দল করেনি সেই সময়। এটা মাথায় আসেনি তাদের দল করলে বাড়ি, গাড়ি, টাকা প্রভাব প্রতিপত্তি হয় ক্ষমতা বাড়ে , এলাকায় মাতব্বরি করা যায়, অর্থ কামানো যায়, সেই কথা ভেবে কিন্তু তারা দল করেনি কোনোদিন। এমনি একটা ভালোবাসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে ভালবেসে দল করে যাওয়া আপনমনে।
সেই শ্রীরামপুরে পল্লীডাক এর প্রেসে এমন ঠাণ্ডা পড়লে তরুণ পান আসতো মোটর সাইকেল নিয়ে ঘরের চাষের আলু মাঠ থেকে উঠতে শুরু করলেই। ব্যাগ করে আলু নিয়ে আসত সেই তরুণ। নিজের ঘরের চাষের চন্দ্রমুখী আলু নিয়ে সাংবাদিকদের দিতে আসতো সে। সেই আলুর স্বাদ আলাদা। সন্ধ্যায় চা, চপ মুড়ি খেয়ে আড্ডা মেরে গ্রামে ফিরত সে মোটর সাইকেল চালিয়ে। আসলে এমন মেঠো সম্পর্ক আজকাল আর কোথায় মেলে। সাংবাদিক আর তার খবরের সোর্সের। এখন তো সব ক্ষেত্রেই দেওয়া আর নেওয়ার সম্পর্ক। মোবাইলের দাপুটে যুগে সাংবাদিক কাগজে নাম লিখবে, টিভির পর্দায় ছবি দেখাবে বিনিময়ে সে তার রিটার্ন বেনিফিট যথা সময়ে পেয়ে যাবে প্রমাণ সহ। এটা যে এখন দিনের আলোর মতই পরিষ্কার। ফেলো কড়ি মাখো তেল। সেই ভজা আর তরুণের আমলে এমন গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যায়নি এই বাংলার মেধার মিডিয়াকূল। আজকাল যা আকছার দেখা যায়। আর তাই বোধহয় ভজা তরুণের কথাও ভুলে গেছি আমরা বহুদিন হলো।
কিছুদিন আগেই শ্রীরামপুরের বেল্টিং বাজারে বাস থেকে নেমে দেখলাম সেই এক চিরাচরিত পোশাক পরে, পায়ে সস্তার চটি পড়ে হেঁটে আসছে ভজা ধীরে সুস্থে। ওর পোশাকের কোনও বদল হয়নি কোনোদিনই। গালে সাদা কদিনের না কত দাড়ি। আমি ওদিকে কোথাও যাচ্ছিলাম বাজারের পথে। আরে অভিজিৎ দা, বলে সেই অমলিন হাসি ভজার। ওর নিস্প্রভ চোখের দৃষ্টিতে ফালাফালা করে দিলো যেনো আমায় ও। আগে এইভাবেই তো সে শেওড়াফুলি স্টেশনে নেমে ছাতুগঞ্জে আকবরদার অফিসে যেতো ভজা একসময় ঘরের মুড়ি নিয়ে বহু দিন আগে। মেজদির হাতে মুড়ি তুলে দিত। সারাদিন সেখানে দাঁড়িয়ে বড়ো ভাই এর বকা খেয়ে, গাল শুনে আর মেজদির হাতে রান্না খেয়ে, পেট ভরে ভাত খেয়ে সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে যেতো তারা। এইভাবেই তো তারা দলকে ভালবেসে গেছে সারা জীবন ধরেই।
দিন বদলে গেছে অনেক এখন আর শেওড়াফুলি যেতে হয়না তাকে। শ্রীরামপুরেই কাজ মিটে যায় যদি কাজ এর জন্য আসতে হয় তাকে খুব দরকার পড়লে। কিন্তু ভজা মনে মনে ভাবে আগের দিনগুলো বেশ ভালই ছিল যেনো। এখন কেমন পানসে লাগে যেনো ওর। মনে মনে তার প্রশ্ন জাগে তাহলে দল কি ক্ষমতায় এসে একটু বদলে গেলো বা পাল্টে গেল। কে জানে সেটা ঠিক বুঝতে পারে না সে এই এত বছর পরেও। কিন্তু সে তো আজও নিজেকে বদলে নিতে পারলো না কিছুতেই।
আমার আশেপাশে তো আর ভজাদের দেখতে পাইনা আমি আজকাল একদমই। তরুণ পান তো কবেই মরে গেছে কত কম বয়সেই। ওর কি হয়েছিল কে জানে আমি জানিনা। এখন আমার চারিদিকে বড়ো বড়ো চেহারার সব ঝকমক করা দামী দামী গাড়ি, মানুষের ভীড়ে উপচে পড়ছে রাস্তায়, পথে, ঘাটে সর্বত্রই। সাদা, কালো, নীল, লাল সব নানা রঙের বাহারি গাড়ী। বড়ো, মেজো, সেজো, ছোটো নেতার ভীড় উপচে পড়ছে আমার আশপাশে। আমার চারিদিকে সব দাপুটে নেতাদের ভীড়।
আমি দেখলাম ভজা যেনো আমাকে দেখছে আর আমিও ভজাকে দেখছি অপলক নয়নে। দুজনেই যে বদলে যেতে পারিনি কিছুতেই এতদিন পরেও। আমি আসছি দাদা বলে ভজা একা একাই এগিয়ে যায় আমায় ফেলে ধীর পায়ে। আমি ভাবলাম সত্যিই অসাধারণ এই ভজা আর তরুণ এর জুটি। যে জুটি ভেঙে গেলেও , তার স্বপ্নের দল পাল্টে গেলেও, আশপাশের চেনা মানুষগুলো পাল্টে গেলেও ভজা একাই আজও বিশ্বাস, নিষ্ঠা, আর ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছে সে তার বস্তা পচা আদর্শকে বুকে আঁকড়ে। শুধু দিদিকে ভালোবেসে আর মা মাটি মানুষকে ভালোবেসে। হাজার ভীড়ের মাঝে একা একদম একা হয়েই বেঁচে আছে সে আজ। আর আমিও ওর কথা ভাবতে ভাবতেই বাজারে ভীড়ের মাঝে মিশে গেলাম একা একদম একা। জনারণ্যে দুজনেই যে আমরা বড়ো একা। একদম একা।
ভজা আর তরুণের গল্প - অভিজিৎ বসু।
নয় ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
খুব ভালো লেখা। তৃনমূলের এমন কর্মি এখন হাতে গোনা কয়েকজন।
উত্তরমুছুন