জীবনের এই দৌড়ে নিজের পায়ে ছুটে চলা এদিক থেকে সেদিক। কত হাসি, উচ্ছলতা, আনন্দ আর দৌড়ে বেড়ানো। আর হঠাৎ করেই কেমন স্থবির জীবনে কোনো ভাবে ঘরের ভেতর বেঁচে থাকা বন্দী হয়ে ঘরের ভেতর একা একা। এই দিন যাপনের এই দুই চিত্র। জীবন কাটানোর এই দুই ছবি দেখে কেমন যেনো থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়।
সত্যিই জীবন বড়ই অদ্ভুত তাই না। মুদ্রার এক পিঠে কত হৈচৈ হুল্লোড় আর আনন্দ করে জীবনকে উপভোগ করা এক নিঃশ্বাসে। আর অন্য পিঠে শুধুই একটি ঘরে অপেক্ষা করা, হা হুতাশ করা, দীর্ঘশ্বাস ফেলা। আত্মীয় স্বজনের জন্য, মেয়েদের জন্যে, নাতি নাতনীর জন্য, জামাইদের জন্য, সবার জন্যে শুধুই অপেক্ষা। যে অন্তহীন অপেক্ষার কোনও শেষ নেই। দিন থেকে রাত। রাত থেকে ভোর। শুধুই অপেক্ষার প্রহর গোনা।
সত্যিই দেখতে দেখতে তাঁর জীবনের আরও একটা নতুন বছর চলে এলো। জীবনের খাতায় বেড়ে গেলো তাঁর আরও একটি বছর। কিন্তু কি বা আসে যায় তাতে তাঁর। অশক্ত শরীরে, দুর্বল মনে শুধুই বিছানায় বসে দিনযাপন করা। একটাই স্বান্তনা তাঁর একা একা দিনযাপন করতে হয়না কিছুতেই। সেই কবে থেকেই তো তাঁকে একা হয়ে যেতে হয়েছে। ভেঙে গেছে তাঁর জীবনের জুটি সেই কতদিন কত বছর আগেই। যে জুটিকে হারিয়ে কোনোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। ভাসতে ভাসতে এদিক আর ওদিকের কথা ভাবা।
আজ তাই নিজের জন্মদিনের দিন একা ঘরে বসে মনে পড়ে যায় পুরোনো দিনের নানা কথা। সেই রৌরকেল্লার নতুন সংসার। সেই নদী আর পাহাড়ের অচেনা দেশে ঘর বাঁধা। সেই দুই মেয়েকে নিয়ে নাজেহাল হলেও একা হাতে সব সামাল দেওয়া। কষ্ট করে সংসার চালানো। সেই বড়ো বাড়ির মেয়ে হলেও কেমন কম টাকার চাকরি করা ছেলের সাথে বিয়ে হওয়া। হাসি মুখে সব মেনে নেওয়া। ধীরে ধীরে এইভাবেই যে এডজাস্ট হয়ে যাওয়া। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার লড়াই করে জীবনকে চালিয়ে নেওয়া তাঁর।
দেখতে দেখতে ছোটো মেয়ে আর বড়ো মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া। সবে যখন একটু ঝাড়া হাত পা সংসারে দু দণ্ড বিশ্রাম এর সময় এলো তাঁর তখন তো টুক করে ঘর বাঁধা মানুষটা তাকে ছেড়ে হঠাৎ করেই চলে গেল তাঁকে ফাঁকি দিয়ে দুরে অনেক দূরে। চোখের জল শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো তার। একা একা আবার থাকার শুরু। যেটা তাঁর কাছে সব থেকে কষ্টের। আর তাই তো বড় মেয়ের ঘরে চলে আসা নিজের ঘর ছেড়ে। দেখতে দেখতে প্রায় বিশ বছর বড়ো মেয়ের ঘরেই বাস করা। হাসি, কান্না, আনন্দ, দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট সব কিছুকে নিয়েই থেকে যাওয়া।
আজ কত স্মৃতি যে ভেসে আসছে তার এই জন্মদিনের দিন। সেই শ্রীরামপুরে বড়ো মেয়ের ফ্ল্যাট। সেই তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে একা একা ধরে নিজে হেঁটে রাস্তায় নামা। সেই সবার সাথে হাসি মুখে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া। ছবি ওঠা এই জীবনে যে সে সব কিছুই ছিল তাঁর একদিন। সেই দুর্গাপুর যাওয়া ছোটো মেয়ের বাড়ি, সেই বেনারস ঘুরতে যাওয়া তাদের সাথে। সেই দক্ষিণ ভারত দর্শন করা বড়ো মেয়ের হাত ধরে। সেই পার্ক স্ট্রীট এর আলোকোজ্জ্বল রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো সব কিছুই যে তাঁর উপভোগ করা হয়েছে। আর এর মাঝেই তো বদলে গেলো জীবন। সেই তিন্নি, বাবু, বুটা নয় নানু দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেলো কত ওরা তিনজন।
যে জীবনে তার কমে গেলো হাঁটার ক্ষমতাও। যে জীবনে জানলা গলে সূর্যের রোদ দেখেই দিন আর রাতের ফারাক বইতে হয় তাঁকে এখন। বোলপুরে ফ্ল্যাট বাড়ির চার দেয়ালে এখন বন্দী তাঁর জীবন। ঘরের দরজা খুলে কেউ ডাকলে দেখতে পায় সে মানুষের মুখ। এখন শুধুই অপেক্ষা আর অপেক্ষা । কারুর ফোনের জন্য অপেক্ষা, কারুর ডাকের অপেক্ষা। চেনা মানুষের হাসি মাখা মুখ দেখার অপেক্ষা। নাতি আর নাতনিদের একটি বার দিদা বলে ডাক এর অপেক্ষা। তাঁর মেয়েদের মা বলে ডাকার অপেক্ষা। জামাইদের একটু হাসি মুখের দেখার অপেক্ষা। সত্যিই অসাধারণ এই অপেক্ষার জীবন।
সত্যিই অসাধারণ এই জীবনের শেষ ভাগ। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে কাটিয়ে দেওয়া এই জন্মদিনের দিন। অন্য আর পাঁচটা সাধারণ দিন। শুধুই একটু বেঁচে থাকার জন্যে। যে অন্তহীন অপেক্ষার প্রহর গোনার শেষ নেই কোনও। শুধু তাঁর মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনের কথা। দৌড়ে, হেঁটে, রান্না করে, সংসার করে, বেড়ানো দিনগুলোর কথা। অন্ধকার ঘরে রাত নামে। ধীরে ধীরে ভোর হয়। অন্তহীন অপেক্ষা নিয়েই বেঁচে থাকে সে একা একদম একা।
যাঁর আশপাশে আজ আর কেউই নেই। সেই ঘর বাঁধা মানুষটাও নেই। মেয়েরাও কেমন দূরে চলে গেছে তাঁর। নাতি নাতনীরাও কেমন আলগোছে সম্পর্কের মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলে। দুই জামাইও কেমন করে যেনো আলাদাই থেকে যায় কাছে থেকেও। আর এটাই আজ তাঁকে জন্মদিনের সন্ধ্যায় খুব কষ্ট দেয়,যন্ত্রণা দেয়, অপেক্ষার প্রহর গোনার পরামর্শ দেয়।
জন্মদিনেও অপেক্ষার প্রহর গোনা - অভিজিৎ বসু।
পঁচিশ ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি নিজস্ব সংগ্রহ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন