আজ আর সাদা জীবনে কালো কথা নয়। আজ এই কঠিন ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে সাদা জীবনের ভালো কথা। একেবারে অমৃত কথা। যাকে এই পোড়া জীবনে আস্বাদন করতে পারলে জীবন ধন্য মনে হয়। ঠিক যেনো হরিনাম সংকীর্তন এর রস আস্বাদন করতে পারা। শুকনো মরচে ধরা জীবনে একটু রসের স্বাদ পাওয়া। আর সেই রসের স্বাদের ভাগীদার হওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার বলতে পারেন।
প্রতি বছর শীত এলেই মনটা আমার কেমন এই রসের স্বাদ পাওয়ার জন্য ছট ফট করতো। অপেক্ষায় থাক- তাম কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষন। ছোটো বেলার কথা আমার খুব মনে পড়ে যায় এই শীতের সময়। স্কুল ফেরত এসে যেদিন দেখতাম মা রান্নাঘরের বারান্দায় শিল পেতে ঘড় ঘড় শব্দে সাদা ডাল বাটতে বসেছেন সেদিন বুঝতাম আজ এসেছে সেই পরম আনন্দের দিন মাহেন্দ্রক্ষন।
আজ হবে বাড়িতে রস বড়া। তাই দুপুর বেলায় তাড়া তাড়ি করে খাওয়া দাওয়া শেষ করে মা একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে একমনে বিউলি ডাল বেটে তাকে ভালো করে গামলায় ফেটাতে থাকতেন। আর সেই ভেজা বিউলি ডালের সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত গোটা ঘরে ম ম করে। একদম কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সেই ছোট্ট টালির একচালা ঘরের ভিতর। শীতের কুয়াশার চাদর ভেদ করে টালির ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সেই গন্ধ চারি দিকে ছড়িয়ে পড়ত। ডাল এর বড়া ভাজার সেই মিষ্টি সুবাস।
একদম গোল গোল হালকা লাল আভার সেই ছোটো ছোট বলগুলো গরম তেলের মধ্যে পড়ে কেমন যেনো হাবু ডুবু খেত লুট পুটি খেত একে অপরের ওপর। ঠিক যেমন আমায় অঙ্কের ক্লাসে চক আর ডাস্টার হতে ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক করতে বললেই আমি হাবু ডুবু খেতাম ঠিক তেমনি অবস্থা ওদের হতো। আর আমার মা তখন গম্ভীর মুখে সেই পিতলের ছোটো ছাঁনচা দিয়ে একমনে তাদের লজ্জা ভাঙাতে ব্যস্ত থাকতেন।
আমার আজও মনে আছে আর এই ছাঁনচা দিয়েই তো সেই দশমীর সময় দুপুর বেলায়। গরম বোদে আর নিমকি তৈরির সময় একবার একটু মার কাছে হাত পেতেছিলাম। ঠাকুর বিসর্জনের আগে কেনো মার কাছে চেয়েছিলাম। তাই বলে গরম তেলের কড়াই থেকে গম্ভীর মুখ তুলে কড়া দৃষ্টিতে ছাঁনচা তুলে ডান পায়ের ওপর মেরে ছিল মা। চোখে টল টলে জল নিয়ে ভেজা চোখে মার মুখটা দেখারও সাহস হয় নি সেই দিন। ভয় পেয়ে কাঁদতেও পারিনি সেদিন। যদি আরও মার খাই।গরম তেলের দাগটা বহুদিন ধরেই ছিল আমার ডান পায়ের ওপর।
ধীরে ধীরে ছোটো বেলার সেই লাল দাগ মিলিয়ে গেল। আমিও আর মার কাছে বায়না করা ভুলে গিয়ে বড়ো হয়ে গেলাম কেমন করে নিজেই অজান্তে বুঝতেই পারলাম না। মার হাতের সেই ছাঁনচা দেখে আমার মতই ভয় পেয়ে কেমন গরম তেলের কড়াইতে এদিক ওদিক দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছে ওরা। কিন্তু পালাবার হাজার চেষ্টা করেও সফল হতে পারছে না কোনো ভাবেই, সেই ডালের বড়াগুলো। তারপর মার হাতে ধরা পড়ে যায় ওরা একসময়।তারপর সব গুটি সুটি মেরে লজ্জায় সেই মার সব থেকে বড় কানা ওঠা ডেকচির মধ্যে আশ্রয় নিত ডাল এর লাল লাল বড়া ভাজা গুলো। যেখানে আগে থাকতেই ভর্তি আছে সেই রসে টইটুম্বুর ডেকচি।তার মধ্যে ওরা পড়ে সত্যিই কেমন হাবু ডুবু খেতে থাকতো।
সেই আমার অঙ্কের ক্লাসে স্যার এর ডাক শুনে যেমন আমি হাবু ডুবু খেতাম ঠিক তেমনই। শীতের এই ঠাণ্ডার কামড়ে কেমন যেনো সব এলোমেলো হয়ে গেছে জীবনের ছন্দ। লেপের নিচে বসে থাকলেও হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে আমার সেই সাদা জীবনের প্রথম ভাগের কথা। শীতের দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ হলেই অপেক্ষা করতাম কখন মা ঘুমিয়ে পড়বেন। তারপর সুযোগ পেলেই চুপিসারে পা টিপে টিপে রান্না ঘরে ঢুকে সেই ডেকচি খুলে গুনে গুনে বড়া মুখে পুড়তাম।
কেউ যাতে বুঝতে না পারে তার জন্য নানা ফন্দী বের করতাম আমি। কিন্তু না রাতের বেলায় মা ঠিক ধরে ফেলতেন। বলতেন তুই বড়া খেয়েছিস দুটো। আমি চুপ করে মার সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকতাম। আর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডায় জমে কাবু হওয়া সেই বড়া আমার শরীর মন কে অবশ করে নিচে নেমে যেত। আর এই স্বাদকে আমি জিভে রেখে দিতে জল খেতাম না বহুক্ষণ।কিন্তু কি করে যে মা, ধরে ফেলত কে জানে।
তারপর ধীরে ধীরে বড়ো হলাম আমি। কিন্তু প্রতি বছর শীত এলেই আমি মাকে ফোন করে বলতাম কবে হবে গো মা রসবড়া। মা ফোনের ওপর দিক থেকে বলতেন, অনেক বয়েস হয়েছে আর আমি এসব ঝামেলা করতে পারবো না এই বছর। তোর বউকে বল করে দেবে। মা জানতো বউ এসব পারে না। তবু বলতেন সেকথা আমি ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে চুপ করে শুনতাম। মা কিছু বলতেন না আর কবে হবে। তার কোনো আভাসও দিতেন না।
তারপর ঠিক একদিন এমন শীতের সন্ধ্যায় দুধের স্টিলের সেই বহু পুরনো ক্যান করে মা,বাবাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন রসবরা। শীতের ঠাণ্ডা গায়ে মেখে বাবা চাদর মুড়ি দিয়ে সেই রস বড়া পৌঁছে দিয়ে যেত বাবুকে দিও বলে। অফিস থেকে ফিরে এসে সেই অমৃত সুধা আর আমৃত স্বাদের বড়ার স্বাদ আস্বাদন করে স্বর্গীয় অনুভুতির সুখ পেতাম আমি।
এই বছরটা শীতের কামড়ে সেই রস বড়া তৈরীর কথা মাকে আর ফোন করে বলতে পারলাম না আমি। মা যে কেনো আমায় ছেড়ে চলে গেলো দুম করে কে জানে। আর কিছু দিন থাকলে কি ক্ষতি হতো তোমার বলো মা। আমি যে আর কারুর কাছে মা শীত পড়লে বলতে পারবো না, মা রস বড়া কবে হবে গো। তুমি যে চুপ করে আর আমায় কথা শোনাবে না তোর বউকে বল। আমার শরীর ভালো নেই করতে পারবো না। তারপর এসব বলেও ঠিক তুমি তা তৈরি করে পাঠিয়ে দেবে। অফিস থেকে ফিরে দেখবো খাবার টেবিলে তোমার হাতের স্পর্শ পাওয়া সেই অমৃত ভান্ডার অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমি দু হাতে তাকে জড়িয়ে ধরবো। তারপর তাকে ধীরে ধীরে খুলে দেখবো তোমার ভালোবাসার ছোটো ছোটো স্পর্শ গুলো আমার দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে কেমন মায়াময় চাহনি দিয়ে আমার দিকে অপলক নয়নে আমার তাকিয়ে আছে। বলছে বাবু ,আমি তো আছি তোর কাছেই আছি।
আমার সেই ছোটো বেলার কথা বড়ো বেশি করে মনে পড়ে যায় এই বুড়ো বয়সেও। মনে পড়ে যায় সেই ডান পায়ের গরম ছাঁনচার মারের দাগটার কথা এই শীতের হাড় কাঁপানো সন্ধ্যায়। ধীরে ধীরে আমি হাত বুলিয়ে দেখি না সেটা আর নেই এক দম মিলিয়ে গেছে সেটা উধাও হয়ে গেছে। তাকে আমি খুঁজে বেড়াই শীতের সন্ধ্যায়। না, খুঁজে পাই না তাকে।দেখি আমার দু চোখের বাঁধ ভাঙা জলে ভেসে যাচ্ছে আমার অতীত, বর্তমান আর ভবিষৎ। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে সেই লাল দাগটাকে খুঁজে বেড়াই। হাতড়ে বেড়াই সেই লাল দাগটাকে। অস্ফুটে বলি মা তুমি একবার এর জন্য ফিরে এসো। একটি বার। মা চুপ করে থাকে কোনো উত্তর দেয় না।
শীতের রসবড়া - অভিজিৎ বসু।
আঠারো জানুয়ারি দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য গুগুল ও নিজস্ব।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন