কত দিন পর যে টোটন আবার ফিরে এলো আমার কাছে কে জানে। কিছু মানুষের সাথে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যাওয়া আবার তার হারিয়ে যাওয়া এই জীবন থেকে। আবার জীবনের রাস্তায় তার সাথে দেখা হওয়া বেশ ভালো লাগে কিন্তু এটা। এই একটা আমাদের ছোট্টো জীবনের মাঝে এই হারিয়ে যাওয়া আর ফিরে আসার জোর লড়াই। সাদা জীবনের কালো কথায় আজ তাই সেই টোটন কোনার এর জীবনের গল্প।
সেই সোনাঝুড়ির জঙ্গলের মাঝে শান্তিসুধা গেস্ট হাউস। সেই গেস্ট হাউসের রুম এর সার্ভিস বয় টোটন কোনার। সুন্দর দেখতে বেশ ভদ্র মার্জিত শিক্ষিত একটি ছেলে। সেই টোটন যার শিক্ষাগত যোগ্যতা সংষ্কৃত ভাষা নিয়ে এম এ করে বি এড পাশ করেছে সে হাসতে হাসতেই কাউকে বুঝতে না দিয়ে। আর বাবা শিক্ষক হওয়ায় নিজেও শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখেও স্বপ্নভঙ্গ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে সে জীবনের একদম শুরুতেই। আর তাই বোধহয় কিছুটা আত্মগ্লানি আর লজ্জায় শিক্ষক হবার স্বপ্ন ভুলে গেস্ট হাউসের কাজ নেয় সে খুব কম টাকার। সেই হোটেলের ম্যানেজার জয়ন্ত দা। খুব সম্ভবত নৈহাটিতে বাড়ী তাঁর। বেশ ভালোবাসেন তাকে।
সেই সব কথা আজ থেকে প্রায় সাত আট বছর আগের কথা হবে মনে হয়। শান্তিনিকেতনের মাটিতে আমার পা দেওয়া সেই প্রথম। সেই নির্জন ফাঁকা শান্তিসুধা গেস্ট হাউসে টোটন এর গলায় স্যার ডাক শুনে কেমন যেনো কানে একটু খটকা লেগেছিল আমার সেদিন। একটু অস্বস্তি হয়েছিল ওর এই স্যার ডাক শুনে। কথায় কথায় ওর সাথে ভাব জমালাম আমি। জানলাম ওর কথা। সেই ওর ঝরঝরে সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে যাবার কথা জানলাম। ওর গুসকরার বাড়িতে মা বাবা আর বউ আর ছোট্ট ছেলের কথা শুনলাম। ওদের জন্য তো ওর এই কাজ নেওয়া। সেই ছোট্ট একরত্তি ছেলের জন্য।
আসলে জীবন বড়োই অদ্ভুত। জীবনের এই ধরনের মানুষগুলো আরও অদ্ভুত। তাদের মাঝে এই টোটনের মত মানুষের জীবন আরও অদ্ভুত। যাদেরকে দেখে ঠিক বোঝার উপায় নেই। তারা সামনে এক ভেতরে অন্য এক মানুষ। সত্যিই বিদ্যা বিক্রি করতে গিয়ে যারা ওর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলল তাদের হয়তো কোনো ক্ষতি হয়নি এই জীবনে। কিন্তু টোটন এর জীবনে তো অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে গেলো। তাতে কার কী বা আসে যায়।
আর সেই ক্ষতি সামলাতে আর ওর ঘর সংসার সামলাতে এই কাজে আসা। হাসিমুখে কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে মুখ বুজে গেস্টদের সাহায্য করে দেওয়া আর খাবার দিয়ে, ঘরের সার্ভিস দিয়ে তাদের খুশী করা। বুকের মাঝে অনেক কষ্ট অপমানকে সহ্য করেও সে এই কাজ করেছে হাসিমুখেই। সত্যিই কি অসাধারন এই লড়াই ছিল ওর। যে লড়াই আমি করতে পারি নি এই পাঁচ বছরে সেই লড়াই হাসিমুখে করে দেখালো সেই কম বয়সের শিক্ষিত এম এ পাশ ছেলে টোটন কোনার। ওকে মনে মনে প্রণাম জানালাম আমি।
আজ হঠাৎ করেই বহুদিন পর কথা হলো ওর সাথে। কথা বলতে বলতে জানালো টোটোন সেই বর্তমান কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ওর সেই গেস্ট হাউজ এর কাজ নেওয়া এই শান্তিসুধা গেস্ট হাউসে। তারপর ধীরে ধীরে গেস্ট হাউসে কাজ ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন পর চলে আসা ওর গ্রামের বাড়িতে। মন কি আর মানে যে কোনো কাজ করতে স্যার। শিক্ষার জগতে ফিরতে চায় সে তাই। আর তাই ওর আউশগ্রাম স্কুলে খুব অল্প টাকায় পড়ানোর কাজ শুরু করা গেস্ট হাউজ এর কাজ ছেড়ে দিয়ে। সাথে অন্য কিছু কাজও করছে সে বর্তমানে। একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে কাজ করে ওর বউ। এখন একটু ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে টোটন ফের। হয়তো সামনে ফেব্রুয়ারি মাসে স্কুলের শিক্ষক এর একটা কাজও জুটে যেতে পারে তার এমন আশার আলো দেখছে সে। বলতে বলতেই ওর গলায় সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে বলা স্যার, শিক্ষা সর্বং গচ্ছতি। তাই বোনকে স্যার আপনি এম এ পড়ান ওর ভালই হবে।
আজ সেই টোটনকে ফিরে পেয়ে আমার এত ভালো লাগলো কি বলব। শান্তি সুধা গেস্ট হাউস এর কাজ ছেড়ে মাঝে মাঝেই ও কাজের খবর নিত আমার কাছে টোটন। স্যার কোনো খবর পেলে দেবেন কাজ এর। না, দিতে পারিনি আমি ওকে কোনো কাজ এর খবর। ওকে নম্বর দিয়েছিলাম আমি। ভেবেছিল রিপোর্টার এর অনেক ক্ষমতা হয়তো। কিন্তু পারিনি কাজ দিতে ওকে।
আজ সেই হারিয়ে যাওয়া টোটন, ওর হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নকে ধীরে ধীরে ফিরে পেয়েছে সে আবার। যে স্বপ্নকে সফল করতে সে উঠেপড়ে লেগেছে। হারিয়ে যাওয়া আর হেরে যাওয়া জীবনের মাঝে আবার নতুন করে আশার আলো দেখতে পাচ্ছে সে একটু একটু করে। আর তাই আজ ওর সেই আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাওয়া ওর গলা শুনে নিজের কেমন এই হেরে যাওয়া জীবনে আনন্দ লাগলো। সেই ওর স্যার ডাকটা আজও কেমন কানে লাগলো আমার। বললো স্যার বাড়ী আসুন, ম্যামকে নিয়ে , বোনকে নিয়ে।
ওর এই বাড়ী আসার আহবান শুনে নিমন্ত্রণ শুনে মনটা বড়ো ভালো হয়ে গেলো আমার। কে আর কার বাড়ীতে যেতে বলে আজকাল সবাই যে হিসেব করেই আর নিমন্ত্রিত মানুষের স্ট্যাটাস দেখেই তাঁকে বাড়িতে ডাকি আমরা। কে আর বলে স্যার সবাই মিলে আসুন। আজ কেমন যেন ওর কাছে হেরে গিয়েও বড়ো ভালো লাগলো আমার।
হেরে যাওয়া একটা জীবন, মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া একটা জীবন, এই ঘুরে দাঁড়ানো একটা গ্রাম্য জীবনকে মনে মনে স্যালুট জানাতে ইচ্ছা হলো আমার। তুমি ভালো থেকো ভাই টোটন। এমন করেই গাড়ী চালিয়ে জীবনের মোরাম রাস্তায় তুমি বিন্দাস ঘুরে বেড়াও। আর মাঝে মাঝে আমায় ফোন করো তবে স্যার বলে নয় দাদা বলে।
হারিয়ে যাওয়া টোটন - অভিজিৎ বসু।
উনত্রিশ জানুয়ারী, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন