সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মিষ্টি চালের সুবাস, পৌষের গন্ধ মেখে গল্প শোনায় বাংলার গ্রাম

সুন্দর মাটির নিকোনো উঠোন। মাথার ওপর পুরনো টালির চালা। লাল পেড়ে ছাপা শাড়ি পরে ঘরের মাঝে পা দিয়ে ঢেঁকির স্বর্গে যাওয়ার মতো চাল ভাঙা। গ্রাম বাংলার এই চিরন্তন ছবি আজও অমলিন হয়েই বেঁচে আছে আমাদের কাছে। 

পৌষ পার্বণে পৌষ সংক্রান্তির দিন নতুন চালের গুঁড়ো করে চাল গুঁড়ি করে পিঠে করার আয়োজন করা হয় গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে। আর সেই চাল গুঁড়ি যতই মেসিনে করা হোক এখনও বেশ কিছু জায়গায় ঢেঁকিতে চাল ভাঙার ছবি দেখতে পাওয়া যায়। যা দেখে মন ভালো হয়ে যায় বড়ো। 

সেই গুনগুন করে গান, চাল ভাঙিয়ে চালনি করে ছেঁকে নেওয়া। সেই মিষ্টি চালের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে উঠোনময়, মাটির নিকানো উঠোনে তখন এক পা, এক পা করে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসা কাক আর শালিকের দল। আর চারিদিকে ম ম করছে মিষ্টি গন্ধ। কেমন ধুপধাপ করে ছন্দময় আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা মাটির বাড়িতে। 

আর সেই ছন্দের তালে তাল মিলিয়ে পা দিয়ে চাল কোটা গ্রাম্য মহিলার। এই ছবি পুরুলিয়ায়, এই ছবি বাঁকুড়ায়, এই ছবি বীরভূমে সর্বত্রই। যে ছবি দেখে মনে পড়ে যায় সংক্রান্তি এসে গেলো। সেই সংক্রান্তির মিষ্টি ঠাণ্ডা সকালে ঘুম ভেঙে উঠেই মকরের স্নান সেরে জেগে ওঠা। ঘরের মাটির উঠোনে আলপনা দেওয়া। 

আর এসো মা পৌষ লক্ষ্মী, বস মা পৌষ লক্ষ্মী , জন্ম জন্ম থাক মা আমার ঘরে। এই ভাবেই পৌষ মাসে ধন লক্ষ্মী কে বরণ করে নেওয়া। জ্যৈষ্ঠের রুক্ষ জমিতে আষাঢ় শ্রাবণ মাসে যখন বৃষ্টির দেবতার আশীর্বাদে অঝোর ধারায় ঝরঝর বরিষণে ঝরে পড়ে বৃষ্টির জল ধারা। তখন গ্রামের কৃষকেরা মনের আনন্দে মাঠে মাঠে বীজ বোনে। তারপর সেই বীজ ধান একটু বড় হলে মাঠে মাঠে চাষিরা ধান বীজ পুনরায় রোপন করে। আশা আনন্দের মধ্য দিয়ে সেই সবুজ ধান বীজ চারা একটু একটু করে বড় হতে থাকে। এক আকাশ রোদ্দুর আর বাতাস কে ভালোবেসে সে হিল্লোলিত হতে থাকে। তারপর প্রকৃতির নিয়মে সেই সবুজ ধানগাছে একদিন শ্বেত শুভ্র সাদা ফুল ধান শীষের আগমনকে সূচিত করে। তারপর ধানগাছে থোঁড় অর্থাৎ কচি ধান শীষ বের হয়। বিভিন্ন রোগ পোকার আক্রমণকে প্রতিহত করে কৃষকের স্বপ্নের ধান বীজ একদিন পূর্ণাঙ্গ ধান শীষে রূপান্তরিত হয়। 

আশ্বিন মাসে শারদীয় দুর্গাপূজার পরে কার্তিক সংক্রান্তির পবিত্র দিনে পুণ্য তিথিতে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পড়ে হাতে কেদে নিয়ে ঘটিতে করে জল নিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে কৃষকেরা মাঠে যাই। মাঠের মধ্যে গিয়ে ধান গাছের গুড়িতে সেই জল দিয়ে মা লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করে। তারপর আড়াই গুছি ধান কেটে শুদ্ধ বস্ত্রে জড়িয়ে শঙ্খ বাজাতে বাজাতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় কৃষক যখন বাড়িতে প্রবেশ করেন তখন চাষী বউ পান সুপারি দিয়ে ধান্য লক্ষ্মীকে বরণ করে নেয় ও জলের ধারা দিয়ে ঠাকুর ঘরে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। তারপর নানা উপাচারে সেই ধান্য লক্ষ্মী পূজিতা হন।


তারপর কৃষক বন্ধু অঘ্রহায়ন পৌষ মাসে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মাঠের সমস্ত ধান কেটে আঁটি বেঁধে কখনো মাথায় করে, আবার কেউ সাইকেলে চাপিয়ে, আবার কখনো বা রিক্স বা ট্রাকটার দিয়ে এই ধান কৃষকের খামারে নিয়ে আসা হয়।

এরই মধ্যে একটি নির্দিষ্ট দিন দেখে চাষী নতুন ধানের উৎসব নবান্ন যথাযথভাবে পালন করে থাকেন। ধানের সমস্ত কাজ শেষ হলে আবার কৃষক মাঠের মধ্য থেকে সব শেষে কিছুটা ধান নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ঘরে তোলে এই উৎসবকে বলা হয় পৌষ তোলা উৎসব। এই পৌষের দিনে পৌষ তোলাকে কেন্দ্র করে উৎসব প্রিয় গ্রাম বাংলায় কৃষক তথা চাষীর ঘরে পৌষের দিন গুলিতে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন হয়ে থাকে। বিশেষ করে গ্রামবাংলায় বিভিন্ন রকম পিঠে পুলি আর পায়েস এর আয়োজন করা হয়ে থাকে। 

সেই পৌষ এর অনাঘ্রাত ঘ্রাণ মেখে বেঁচে থাকে গ্রাম বাংলার চিরন্তন এই সংস্কৃতি। চিরন্তন এই গ্রামের মেঠো ভালোবাসা প্রকৃতিকে ঘিরে। যে ভালোবাসার স্পর্শ মেখে শীতের ঠাণ্ডা হাওয়া মেখে ঘরের বাইরে অপেক্ষা করে পৌষ পার্বণের এই উৎসব। যে ভালোবাসার উৎসবে সামিল হই আমরা। 

 মিষ্টি চালের সুবাস গন্ধ মেখে বাংলার গ্রাম- অভিজিৎ বসু।
তেরো জানুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ইটিভির পিনাকপাণি ঘোষ

কিছু মানুষ কত কাছে থেকেও পাশাপাশি এক জায়গায় বাস করেও একসাথে একসময় কাজ করেও যে কত দূরে রয়ে যান নিজের হাসিমুখ নিয়ে আর সেই চেনা ছন্দ নিয়ে সত্যিই বেশ ভালো মজার ব্যাপার কিন্তু এটা জীবনের মেঠো পথে। সেই ইটিভির বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে ঘুরে ঘুরে স্ট্রীট ফুডের ছবি তোলা আর নানা খবর করে খাওয়া দাওয়ার এপিসোড করে একসময়ে বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে যাওয়া ইটিভি নিউজে। আর আমাদের জেলায় বসে সেইসব হাঁ করে দেখা আর কেমন মনের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হওয়া। একেই বলে কলকাতার রাজপথের সাংবাদিক বলে কথা।  সেই যে বার রাষ্ট্রপতি এলেন জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে সেই অনুষ্ঠানের বিশেষ কার্ড জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করা ইটিভির চাকরি করার সুবাদে। কোনো রকমে সেই কার্ড জোগাড় করে এনে দেওয়া তাঁকে আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সেই একদিন দুপুর বেলায় খুব সম্ভবত করোনা শেষ পর্বে বালিঘাট স্টেশন থেকে অফিস যাওয়ার সময় এসি পঞ্চাশ এর বাস এর ভিতরে দেখা হওয়ায় কত গল্প করা দুজন মিলে পুরনো দিনের। আবার উত্তরপাড়ার সেই বিখ্যাত চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে হাসি মুখে দেখা হয়ে যাওয়া রাতের বেলায় কাঁঠালবা...

আমাদের সবার মৃনাল দা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক বাবা আর ছেলের লড়াই এর গভীর গোপন কাহিনী। এই সাংবাদিকতার পেশায় এসে কত লড়াই, কত অসম যুদ্ধ, করে যে কেউ সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে হাসি মুখে কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে। এমন করে কেউ টিকে থাকার চেষ্টা করেন সেটা বোধহয় আমার জানা হয়ে উঠত না কিছুতেই। যদি না এই পেশায় আমি গা ভাসাতাম এমন করে। জীবনের এই নানা টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভেসে ওঠে এই রাতের অন্ধকারে আচমকা আমার মনের মাঝে। আর আমি চমকে উঠি কেমন করে তাদের সেই কোলাজ দেখে।  এমন এক চরিত্র, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়ে কেমন আলগোছে, হাসিমুখে, নির্মোহ ভাবে, শুধু নিজের কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো সে শুধুই আকাশ পানে তাকিয়ে। যে নীল আকাশের গা ঘেঁষে উড়ে যাওয়া সাদা বকের ডানায় লেগে থাকে মেঘের হালকা টুকরো। একদম যেনো সিনেমার পর্দার হিরোর মতোই। দেখে বোঝার উপায় নেই একদম। পেটে খাবার না থাকলেও মুখের হাসিটা অমলিন হয়েই বেঁচে আছে আজও এতোদিন পরেও। আর সেই বিখ্যাত সাদা পাকা নাসিরউদ্দিন স্টাইলের দাড়ি, কালো চুল, আর সব সময় ধোপদুরস্ত ফিটফাট একজন মানুষ। রাত নটা বাজলেই যাকে শ্রীরামপুরে...

শপিং মলের উদ্বোধনে সিঙ্গুর আন্দোলনের দাপুটে মন্ত্রী

নালিকুল স্টেশন বাজারে একটি শপিং মলের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বেচারাম মান্না হাজির। একসময় যাঁর অন্দোলনের ঠেলায় পড়ে দৌড়ে একপ্রকার পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা কোম্পানিকে। যে আন্দোলনের দগদগে ঘা আর সেই স্মৃতি ধীরে ধীরে আজ প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের কাছ থেকে। আজ সেই চাষার ঘরের মানুষ না হলেও সেই কৃষক আর শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন সেই মানুষটাকেই কেমন যেন আজ শপিং মলের উদ্বোধনে দেখে বেশ ভালই লাগলো আমার।  একদম নালিকুল স্টেশনের কাছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল। দোকানে সাজানো জিনিস পত্র। আর সেখানেই আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বেচারাম মান্না। একদম কেমন একটু আমার অচেনা লাগলো যেন। সেই মুড়ি খেয়ে আলুর তরকারি বা শশা খেয়ে আন্দোলন শুরু করা জমি আন্দোলন এর অন্যতম পথিকৃৎ নেতা আজ এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তাহলে টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে যে জমি দখল নিয়ে আন্দোলন সেই আন্দোলন এর মধ্যে ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। যদিও সেখানেও সেই সময়ের শাসকদলের কর্মসংস্থানের যুক্তি।তবে এই নতুন শপিং মলের উদ্বোধনে তো আর ...

ভীড়ের মাঝে একা

জীবন জুড়ে শুধুই ভীড় আর ভীড়। নানা ধরনের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় মানুষের গন্ধে, বর্ণে , স্বাদের ভীড়ে আমি একদম একা হয়ে যেতে চাই। যে ভীড় উপচে পড়া রাস্তায় শুধুই হেমন্তের ভোরে শিশিরের ফিসফিস শব্দ, পাখির কিচির মিচির আওয়াজ,ধানসিড়ি ওই নদীটির তীর ধরে ঘুঘুর আকুল মন কেমন করা ডাক, উদাসী শালিকের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া ওই হেমন্তের হলুদ ধানের মাঠ এর পাশ দিয়ে, হলুদ বসন্ত বৌরীর সেই আমলকীর গাছের পাতায়,আড়ালে আবডালে বসে কেমন যেন আমায় দেখে লজ্জা পাওয়া, আর তারপর চোখ নামিয়ে হঠাৎ করেই তার উড়ে চলে যাওয়া। আর মেঘের কোল ঘেঁষে সেই সাদা বকের, বুনো হাঁসের, আর সেই পানকৌড়ির জলে ভেজা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া আকাশ জুড়ে। সত্যিই ওরাও যে ভিড়ের মাঝেই বড়ো একা। একা একাই ওদের যে এই বেঁচে থাকা। কেমন নিপাট হৈ চৈ হুল্লোড়হীন একটা জীবন নিয়ে বেশ মজা করে, আনন্দ করে। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে রাস্তার একপাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা ওই সাদা কালো ভুলো নামের কুকুরের। যে অন্তত এই সব মানুষদের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একটু যেনো আলাদা , একটু যেনো অন্য রকমের। একটু একা একাই যেনো ওর এই আলগোছে জীবন কাটিয়...

গৌড় প্রাঙ্গণে আনন্দবাজার

গৌরপ্রাঙ্গনে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের আনন্দের মেলা আনন্দবাজার। মহালয়ার ভোরবেলায় ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের মন কেমন করা সুরে মেতে উঠলো শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গণ। প্রতি বছরের মতো এই বছরও যে হবে আনন্দমেলা আনন্দবাজার। হ্যাঁ সত্যিই যেনো আনন্দের এই হাটে বেচাকেনার পসরা নিয়ে একদিনের জন্য বসে পড়া মন প্রাণ খুলে হৈ হুল্লোড় করে। এই মেলা শুরু হয় 1915 সালের 15 এপ্রিল নববর্ষের দিনে। কিন্তু আগে এই মেলাকে একসময় বলা হতো বৌঠাকুরাণীর হাট। সেই সময় আশ্রমের মহিলারা নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসতেন। মেলার আয়োজন করতেন তারা। আনন্দ করে বেচাকেনা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় একবার গরমের ছুটির আগে এমন মেলা নাকি হয়েছিল। যার নাম ছিল আনন্দবাজার। পরে এই মেলার নামে হয়ে যায় আনন্দমেলা। সত্যিই আনন্দের এই মিলন মেলা।  প্রথমদিকে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মেলা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বভারতীর সব বিভাগের পড়ুয়ারা এই মেলায় যোগদান করে। এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের বেচা কেনার লাভের টাকার কিছু অংশ জমা পরে বিশ্বভারতীর সেবা বিভাগে। সেখান থেকে এ...