শীতের সকালে ঘুম ভেঙে উঠেই আজ সেই দেখতে হিরো দেবুর মুখটা ভেসে এলো আমার কাছে। সেই আমাদের ২৪ ঘণ্টার রাইডার দেবু। কি রে দেবু, কোথায় রে ক্যাসেটটা (পরে যেটা চিপ হয়ে হলো ক্যাসেট থেকে) সেটা এনে দে দেবু। খবরটা ধরাতে হবে তো। একটু পরেই তো অফিসের বাবুরা চিৎকার করবে। দেবুর হাত নেড়ে অভয় বাণী দিয়ে একগাল হেসে উত্তর, দাদা তুমি কোনোও চিন্তা কোরো না আমি আছি তো নাকি, এত টেনশন নাও কেনো তুমি। এই আমি যাবো আর আসবো। বলেই অফিস এর নীচে গিয়ে মোটর সাইকেল স্টার্ট করে দিত সে ঠিক সিনেমার হিরোর মতো। আর নিমেষে খবরের স্পটে পৌঁছে রিপোর্টার এর কাছ থেকে ক্যাসেট নিয়ে বা চিপ নিয়ে অফিস এসে আমার টেবিলে ক্যাসেট ছুঁড়ে দিয়ে বলতো অভিজিৎ দা এই নাও। আর একদম শাহরুখের মতো করে একগাল হেসে বলতো এর জন্য এত চাপ নিওনা তুমি। আমি আর জয় আছি তো নাকি।
হ্যাঁ, এই বাংলা মিডিয়ায় একটা সময় রাইডার এর চল ছিল বেশ। সেই ঘটনার স্পট থেকে দ্রুত প্রথম ছবি হবার পরেই অফিস এর রাইডার বয় দ্রুত গতিতে তার নিজের মোটর সাইকেল করে সেই স্পটে পৌঁছে গিয়ে রিপোর্টার এর কাছ থেকে সেই ক্যাসেট নিয়ে এসে অফিস এর অ্যাসাইনমেন্টের টেবিলে পৌঁছে দেওয়া। আর সেই সময় অ্যাসাইনমেন্টের টেবিলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি ক্যাসেট পেয়েই চিৎকার করে বলতেন, ছবি এসে গেছে দেখাও, দেখাও। আর তিন্নি তখন রান ডাউন এর টেবিল এ বসে বলতো অভিজিৎ দা ছবিটা কেটে আসতে দাও আমার কাছে ঠিক দেখাবো আমি। অযথা এত উত্তেজিত হয়ে যাওয়া ভালো নয় দাদা। এবিপি তো কত আগেই দেখিয়ে দিয়েছে এই ছবিটা।
সত্যিই সেই দিনগুলো কিন্তু বেশ ভালই ছিল সেই সময়। সেই দৌড়ের জীবন, সেই ছুটে বেড়ানোর জীবন, সেই রাইডার দেবু আর জয়ের জীবন গুলো বেশ ভালোই ছিল কিন্তু। আর সেই সময় তিন্নির ভয়ে কিছুটা আমি গুটিয়ে যেতাম ওর দাপুটে মূর্তি দেখে। আর ধীর পায়ে সেই বাংলা মিডিয়ার বিখ্যাত সুবীর চক্রবর্তী এসে বলতো এই বুড়ো তুমি চুপ করবে কি। আমি আছি তো ছবি কাটছে নরেন ঠিক দেখানো হবে। অযথা চিৎকার করোনা তুমি। এইভাবেই দড়ি টানাটানির খেলা চলতো প্রোডিউসার আর অ্যাসাইনমেন্টের মধ্যে। কিন্তু দু পক্ষের সম্পর্ক নষ্ট হয়নি কোনওদিন।
আমার আবার একটু ওই অ্যাসাইনমেন্টের টেবিলে বসলে ওই উত্তেজনা অনুভব না করলে কেমন যেনো পানসে পানসে লাগতো কাজটা। ঠিক ওই বুড়ো বয়সে ভায়াগ্রা সেবনের মতো ব্যাপার আর কি। সে যাকগে কথা হচ্ছিল রাইডার নিয়ে। এই বর্তমানের বাংলা মিডিয়ার এক বিখ্যাত ক্রাইম বিটের রিপোর্টার তো তার আগের প্রথম জীবনে সেই রাইডার এর কাজ করতে করতেই কেমন করে স্পটে গিয়ে ক্যাসেট নিয়ে আসতে আসতেই খবরকে ভালোবেসে একদিন বিখ্যাত ক্রাইম বিটের সাংবাদিক হয়ে গেলো কেমন করে কে জানে নিশ্চয়ই ডেডিকেশন ছিল তাঁর।
আর সেই সাংবাদিক যে ক্যাসেট নিয়ে আসতে গিয়ে একদিন নিউ মার্কেট থানায় বোধহয় হেলমেট ছাড়া আটকা পড়লো। থানা থেকে ফোন এলো নিউজ এর অফিসে। এই নামে কেউ কি আছেন আপনাদের। আর প্রথমে না বলেও পরে অফিস এর এক কর্তা ব্যক্তির কাছে সেই জেলা রিপোর্টার এর ফোন আসায় তিনি থানায় ফোনে যোগাযোগ করে বললেন হ্যাঁ, সে আমাদের অফিসের লোক। সত্যিই এমন কত যে ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় আমার এই শীতের সকালে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে কে জানে।
আসলে কেমন করে যে রাইডার এর প্রয়োজন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে গেলো এই হৈ হৈ করা খবরের নিউজ এর অফিস চত্বরে আমরা ঠিক বুঝতেই পারলাম না। কমলো ওবি ভ্যানের ব্যবহার, কমলো রাইডার বয় দেবু আর জয় এর দৌড়ের কাজ অনেকটাই। কমলো সেই জিতু, মোটা মত দেবাশীষ আর সেই ড্রাইভার কি নাম বেশ ভুলে গেছি আমি তাদের আউটডোর এর কাজও। দিব্যি সুখের আবেশে মোড়া সংসার জীবন চলতো ওদের একসময়। রোজ সন্ধ্যা হলেই সেই মোটা দেবু আসতো দাদা কাল ওবির ডিউটি দাও কোথাও যাই বাইরে। কে কোথায় এখন আছে কে জানে। ওদের সবার মাথার ওপরে সেই মলয় দা ভি স্যাট ইনচার্জ সেও আর নেই ২৪ ঘণ্টায়।
একদিন হঠাৎ করেই কেমন করে যেনো দেবু সামনে এসে দাঁড়ালো দাদা কাল থেকে আমি আর আসছি না। পরে শুনলাম দেবুর কাজ আর নেই। সেই দেবু আর জয় এর জুটি ভেঙে গেলো হঠাৎ করেই এগিয়ে থাকে এগিয়ে রাখে ২৪ ঘণ্টায়। সেই ওদের একসাথে দুজনের দৌড়। সেই ওদের একসাথে একাধিক কাজ করে খবরের ক্যাসেট পৌঁছে দিয়ে অফিসের নাম উজ্জ্বল করা। সেই খবর দেখিয়ে নিউজ চ্যানেলের টিআরপি বাড়িয়ে দেওয়া এই সব এর মধ্যে তো সেই রাইডার দেবু, রাইডার জয় এর একটু হলেও ভূমিকা ছিল এই সংবাদ মাধ্যমে একদিন। আজ তারা বেশ ব্রাত্য হয়ে গেছে এই দ্রুত বদলে যাওয়া মিডিয়ার বাজারে। সেই খবরের দুনিয়ায় এখন লাইভ ইউ আর ট্রিবিউ এর দাপটে কেমন সব রাইডার বয়দের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে অনেক আগেই।
আসলে এই মিডিয়ার বদলে যাওয়া আর দ্রুত গতিতে নিজেদের স্বার্থে অভিযোজিত করে নেওয়ায় রাইডার দের এখন শুধুই পরিযায়ী পাখির মতই কোনোও রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। কোনরকমে নিজেকে বদলে নিয়ে,পাল্টে নিয়ে সেই দৌড়ে টিকে থাকার চেষ্টা করা। সত্যিই অসাধারণ এই মিডিয়ার জীবন। অসাধারণ এই মিডিয়ার সাংবাদিকদের জীবন। অসাধারণ এই রাইডারদের জীবন।
যে দৌড় ঝাঁপ এর জীবনে হঠাৎ করেই কেমন করে একদিন স্থবিরতা নেমে আসে। থেমে যায় ওদের সেই দৌড়। কমে যায় ওদের ক্যাসেট আনার কাজ। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে খবরের দুনিয়া। যে খবরের দুনিয়ায় আজ কেমন যেনো সেই দৌড়ে বেড়ানো, ছুটে বেড়ানো দেবুরা ক্রমেই যেনো পিছিয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। ভালো থাকিস ভাই দেবু। বহুদিন তোর সাথে দেখা হয়নি। কথা হয়নি তোর সাথে। আর আমার শোনা হয়নি, দাদা আমি আছি তো চাপ নিওনা তুমি একদম। ভালো থাকিস ভাই দেবু। মন দিয়ে কাজ কর তুই নতুন চ্যানেলে।
রাইডার দেবু - অভিজিৎ বসু।
বাইশ জানুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
খুব সুন্দর লেখা
উত্তরমুছুন