আজ শুধুই জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর কথা। নতুন বছর পড়তে না পড়তেই চারিদিকে জন্মদিন পালনের ভীড় লেগে গেছে যেনো। নতুন বছরের শুরুর দিনেই রাস্তাঘাটে মাইক বাজিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর হিড়িক পড়ে যায় চারিদিকে। এত আর শুধু মানুষের জন্মদিন নয় যে চুপচাপ করে সেরে নেওয়া যাবে। একটু আড়ালে আবডালে লুকিয়ে চুরিয়ে ঘরের কোণে একটা ছোট কেক কেটে জন্মদিন পালন করে নেওয়া যাবে। এ হলো মা মাটি মানুষের জন্মদিন পালন বলে কথা। একটু তো ধুমধাম হৈ চৈ হুল্লোড় হবেই। পাড়ার মোড়ে মোড়ে জন্মদিনের ঢক্কানিনাদ আর নানা আয়োজন। পাড়ার নেপলা, পাড়ার মোড়ে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাংড়া কেষ্ট আজ বেশ ব্যস্ত মানুষ। কারণ সকাল থেকেই যে মা মাটি মানুষের জন্মদিন পালনের নানা উদ্যোগ। একটু তো ধুমধাম হৈ চৈ হুল্লোড় তো হবেই সবটাই যে তাদের সামলাতে হয়।
কিন্তু সেটা তো বড়ো ব্যাপার বড়ো বিষয় বলে এমন কথা। আজকাল সকাল থেকেই ঘুম থেকে উঠলেই কেমন করে যেনো প্রায় জোর করেই জানিয়ে দেওয়া আজ কার জন্মদিন। কোন ধরনের মানুষের জন্মদিন। সমাজের কোন স্তরের মানুষের জন্মদিন। কোন কাট্যাগরির মানুষের জন্মদিন। সমাজে, সংসারে, হাটে মাঠে,বাজারে তার কেমন প্রভাব আর প্রতিপত্তি। সে রাজনৈতিক, আর্থিক সবদিক থেকেই। তার ওপর নির্ভর করে সেই ব্যক্তির স্ট্যাটাস। আর এই তাঁর জীবনের বিশেষ দিনে জন্মদিনে শুভেচ্ছা পাওয়ার রেটিং।
পাড়ার পাঁচু বা টুম্পা বৌদির বা বাড়ির কাজের মাসীর জন্মদিন হলে এক কথা তার রেটিং হয় এক ধরনের। আবার পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাতে আংটি পরা গলায় সোনার চেন ঝুলিয়ে রাখা পটকাদা। যাঁকে সবসময় এলাকার দাপুটে কাউন্সিলরের সাথে ঘুরতে দেখা যায় মোটরবাইক নিয়ে, তাঁর জন্মদিন হলে একদম অন্য ধরনের উচ্ছাস আর আয়োজন আর শুভেচ্ছার ঢল বয়ে যায় চারিদিক জুড়ে পাড়ার এই গলি থেকে অন্য গলিতে। আর এই নিজের ফ্ল্যাটের একতলার মুখার্জী বাবুর সাথে তিন তলার সাহা বাবুর ঠিক পটে না। মুখার্জী বাবুর একটু সরকারী চাকরীর টাকার দেমাক। আর সাহাবাবুর সেই আর্থিক জোর একটু কম। তাতে কি একতলা থেকে তিনতলায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে তো কোনও বাধা নেই কারুর এই বিশেষ দিনে। লিফট ছাড়াই কেমন পায়ে হেঁটে একতলা থেকে তিনতলায় উঠে আসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। রাস্তা ঘাটে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেও এই উড়ে আসা জন্মদিনের শুভেচ্ছা পেয়ে কেমন বেশ ভালো লাগে যেনো। উড়ে গিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হ্যাপি বার্থডে একতলা থেকে তিনতলায়। সত্যিই অসাধারণ এই শুভেচ্ছার অনুভূতি।
সত্যিই এ এক অন্যরকম অনুভূতি আর শিহরণ খেলে যাওয়া শরীরে, মনে, প্রাণে। যাঁর সাথে কথা বন্ধ, যাঁর সাথে পাড়ার দোকানে দেখা হলেও মুখ দেখা বন্ধ, আবার তাঁর কাছ থেকেই ফুলের গন্ধ মাখা জীবন এর এই বিশেষ দিনের শুভেছা প্রাপ্তি। আচ্ছা আজ থেকে দশ বা বিশ বছর আগে তো এত জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর ঢল ছিল না বোধহয়। নিজের ছবি সেঁটে পাড়ার বা ছোটো বেলার বন্ধু সেই ভজা, বাগা, বিশু, তরুণ, নেরু, হারু, বুড়ো, খোকন, বাবুসোনা , গোপাল, বাবুলাল, অসিত এর কবে জন্মদিন সেটাই জানিনা আমি আজও এতো দিন এতো বছর পরেও।
কিন্তু সেই গুলি খেলার বন্ধুত্ব, সেই ডাঙগুলি খেলতে গিয়ে কপাল কেটে রক্তবার হওয়া বন্ধুত্ব, সেই বর্ষায় মাঠে খেলতে গিয়ে পা কেটে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো আজও টিকে আছে অমলিন হয়ে। সেই দুপুরে আমচুরি করে খাওয়ার বন্ধুত্ব। কই তাদের জন্মদিন তো আজও জানাই হয়নি আমার এই এতো বছর পরেও। কিম্বা সেই আমাদের ত্রিশ বছর আগে বা তার বেশি সময় এর আগের আমার কলেজের সব থেকে কাছের জনের জন্মদিনের তারিখ যে জানাই হয়নি কোনোদিন আমার। তাহলে আজ এত জন্মদিনের ভীড় কেনো রাস্তায়, উপচে পড়া হ্যাপি বার্থডের ভীড় চারিদিক জুড়েই।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে নিজের ওজনের নিজের স্ট্যাটাসের ঊর্ধ্বে থাকা মানুষের জন্মদিনে একসাথে দুজনের ছবি পোস্ট করে শুভেচ্ছার ঢল কেনো রাস্তা জুড়ে, দেওয়াল জুড়ে,এই পিচ্ছিল আলো আঁধারির মেকি সম্পর্কের পথ জুড়ে। কে জানে আমার তো সেভাবে আর আজ কাল জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ভালোই লাগে না আর। কেমন যেনো থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় জন্ম দিনের দিন এলেই।
এই জীবন আর জীবনের সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে মনে হয় জন্মদিন পালন মানেই তো জীবনের ক্যালেন্ডার থেকে খসে যাওয়া একটি দিন। জীবনের খাতা থেকে উড়ে যাওয়া একটি পাতা। জীবনের থেকে খরচ হয়ে যাওয়া একটি বছর। তাহলে সেটা কি সত্যিই সুখের দিন। জন্মদিন মানেই তো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবার একটা দিন। যে দিন চরম সত্যিই হয়ে ধরা দেবে আমাদের সবার কাছে একদিন।
তাহলে কিসের এত উচ্ছাস , কিসের এত নিজের ছবি সেঁটে হ্যাপি বার্থডে টু ইউ বলে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করা। শুধুই কি নিজের জন্য নাকি যাঁর জন্মদিন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া জীবনের শেষ ধাপের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আরও একটি সিঁড়ির আর একধাপ এগিয়ে গেলে তুমি। হাসতে হাসতে কেক কেটে, ফুলের তোড়া নিয়ে। সবার সাথে হাসিমুখে মজা করে মৃত্যুর দিকে। জীবনকে হাসি মুখে বিদায় জানিয়ে।
জন্মদিনের উপচে পড়া ভীড় রাস্তায় - অভিজিৎ বসু।
আট জানুয়ারি, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় সংগ্রহ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন