সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বদলে যাওয়া সোনাঝুড়ির হাট

শনিবারের সেই বিখ্যাত খোয়াই এর হাটে আমরা গেলাম বহুদিন পর রবিবার বিকেলে। বহুদিন পর খোয়াই এর হাটে পা দিয়ে দেখলাম সেই চেনা হাট একদম যেনো অনেকটাই অচেনা হয়ে গেছে। সেই বন্য খোয়াই এর ধূসর হাটে এখন রঙিন ছোঁয়া। যেনো সে ধীরে ধীরে শহুরে জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে একদম তার চরিত্র বদলে গেছে অনেকটাই। রূপ বদলে গেছে অনেকটাই। বেড়েছে তার আকার আর আয়তন অনেকটাই।


 সেই ছোট্ট শনিবারের হাট এখন বাড়তে বাড়তে কদিন বাদেই না প্রান্তিক স্টেশনের কাছে পৌঁছে যায় হেলে দুলে ধীরে ধীরে। উন্নয়নের হাত ধরে একদম সোজা সোনাঝুড়ির জঙ্গল ছেড়ে তেল চকচকে রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে কোমর দুলিয়ে সেই স্লিভলেস টাইট ফিটিং লো কাট ব্লাউজ পরা আপটুডেট মহিলার মতই মিষ্টি মধুর হাসি দিয়ে। 

সত্যিই অসাধারণ এই বদলে যাওয়া হাট। যে হাটের মাঝে,জঙ্গলের মাঝে জোনাকির আর দেখা মেলে না কিছুতেই। লুকিয়ে আছে নানা রঙের বাহারি ফুলের বাগান এর মত নানা ধরনের রিসর্ট আর দামী গেস্টহাউস। কলকাতার বাবু বিবিরা যেখানে উইক
এন্ডে সময় কাটাতে আসেন হাত পা ছড়িয়ে একটু নিঃশ্বাস নেবেন বলে। কোথায় সেই জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে থাকা খোয়াই এর দৃশ্য। যা অবলোকন করে মন ভরে যায়, চোখ ভরে যায় আর প্রাণ ভরে যায়। সবটাই যে এখন একমাত্র এই খোয়াই এর জঙ্গলের সুন্দর আঁধার মাখা প্রকৃতিকে বেচে টাকা আদায়ের কল মাত্র। যার ফাঁদে আটকা পড়ে আজ হাসফাঁস করছে খোয়াই আর তার এই গ্রামীণ হাট। 

সেই আদিবাসী মহিলার মিষ্টি গন্ধ মাখা জীবন আর সেই জীবনের কঠিন যুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে হাট একদিন শুরু হলো এই খোয়াই এর প্রান্তরে, ক্যানালের ধারে সোনাঝুড়ির হাওয়া গায়ে মেখে। সেটাই আজ কেমন করে যেন উধাও হয়ে গেছে ধীরে ধীরে। যে হাটে অল্প কিছু গ্রামের মানুষ নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে এসে বসে থাকতো আর অল্প কিছু শহুরে ক্রেতাদের অপেক্ষায় থাকতো দুটো বিক্রির আশায় সেই হাট কেমন করে যেন বদলে গেছে অনেকটাই।

 সত্যিই কোথায় সেই কোর্ট দাদু, আর কোথায় সেই গান শিখে জীবন কাটিয়ে দেওয়া হাসিমুখের জয়িতাদি। যে শীতকাল এলেই উল দিয়ে পুতুল বুনে নিয়ে আসতো এই শনিবারের ছোট্টো হাটে সাইকেল চালিয়ে। কোথায় সেই কোর্ট দাদু যে সুন্দর সুন্দর নানা রঙের ভেজিটেবল ডাই করা রং দিয়ে কোর্ট তৈরি করে জাপানে পাঠাতো। আর হাটে গেলেই দেখা হলেই মাথা নিচু করে জাপানী ভাষায় বলতো, আরিগাতো মানে ধন্যবাদ। আর হাজি মে মাসিতে মানে হলো কেমন আছেন। 

কোথায় সেই আরও কত সব চেনা টুকরো মুখের অনুজ্বল ভীড়। যে ভীড়ের মাঝে খালি নতুন লোকের উপচে পড়া ভীড়। তাদের নতুন ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা এই হাট যে এখন শহুরে জীবনের সাথে পাল্লা দিতে দিতে নিজেকেও বদলে নিয়েছে অনেকটাই। শুধুই ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে গেছে সেই সাধের মাদল এর সুরে মন কেমন করা খোয়াই এর এই সোনাঝুড়ি হাট। যদিও দেখা হলো সংহিতাদির সাথে। দেখা হলো বাঁধনদার সাথে। সেই নিজের হাতে হার দুল তৈরি করা বাঁধন মণ্ডল এখন পেটের টানে শাড়ী ব্যবসা শুরু করেছেন সংহিতাদির মতই। মেয়েকে দেখেই কাছে টেনে নেওয়া আর ভালোবেসে বলা এইবার আমার গ্রামের বাড়ীতে কিন্তু যেতেই হবে। 

কতদিন পর দেখা হলো সেই চেনা মুখ এর সাথে। তবু তো সেই চেনা মুখ আর অচেনা মুখ এর ভীড় আর দরদাম করে খুব অল্প লাভ করে জিনিস বিক্রি করার প্রতিযোগিতা চলছে এই হাটে জোর কদমে। আর সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে মোরগ লড়াই এর মত জোর লড়াই এখন সাধের এই সোনাঝরা সন্ধ্যার আঁধার নামা সোনাঝুড়ির হাটে খদ্দের ধরার। যে গ্রামীণ হাট ধীরে ধীরে শহুরে সভ্যতার ছোঁয়া পেয়ে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে গেছে ধীরে ধীরে। একদিন হয়তো কবিগুরুর আশীর্বাদে এই হাট আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিশ্বজনীন অঙ্গনে পৌঁছে যাবে শুধুই তার পণ্য বেচাকেনার জন্য। 

সেদিন হারিয়ে যাবে জোনাকির আলো, হারিয়ে যাবে খোয়াই এর চরাচর, হারিয়ে যাবে খোয়াই এর জ্যোৎস্না মাখা রাত, হারিয়ে যাবে সোনাঝুড়ির কুয়াশা মাখা ভোর। হারিয়ে যাবে নিঃস্তব্ধ জঙ্গলের মন কেমন করা শ্বাসপ্রশ্বাস আর লালমাটির মেঠো পথের ধুলো মাখা জীবনের লড়াই করা কিছু মানুষের জীবনের সোঁদা গন্ধ। যাদের জন্য একদিন এই হাট তৈরি হলো আজ তারাই যে একদম ব্রাত্য হয়ে গেছে ধীরে ধীরে এই মা মাটির আর মানুষের কল্যাণে। এই সোনাঝুড়ির হাটে তাই মাঘের সন্ধ্যায় শুধুই বড্ড রঙিন মানুষের উপচে পড়া ভীড়, দামী গাড়ীর ভীড়, তিন চাকার টোটোর দাপাদাপি। যে ভীড়ে আমি বড্ড বেমানান। 

বদলে যাওয়া সোনাঝুড়ির হাট - অভিজিৎ বসু।
ছাব্বিশ জানুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

জামালপুরের প্রদীপ দা

আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় বর্ধমানের জামালপুরের সেই দাপুটে ঠোঁট কাটা সাংবাদিক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এর কথা। সেই বিখ্যাত সুভাষ তালুকদার এর কাগজ সংবাদে মাত্র এক টাকার কাগজে কাজ করা সংবাদ পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক সেই প্রদীপ দা। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বাঁশের ব্যারিকেডের এপারে দূরে দাঁড়িয়েও যে খবর করা যায় সেটা বড়ো মিডিয়ার সাংবাদিকদের হাসি মুখে দেখিয়ে দিয়ে, আর তাদের খবরের ময়দানে গোল দিয়ে শুধু খবরকে ভালোবেসে ছোটো কাগজে কাজ করে চলা সর্বদা হাসি মুখের সেই আমাদের প্রদীপ চ্যাটার্জী দা।  কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে যাওয়া আর এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়া ঝোলা কাঁধে সেই খবরের খোঁজে সেই জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রদীপ দা। সেই বিখ্যাত পন্ডিত রবিশঙ্কর আর উদয়শঙ্কর এর আপন মাসতুত ভাই এর ছেলে সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় দাদা। সেই বামদের আমলে জামালপুরের এলাকায় দাপিয়ে খবর করে ছুটে বেড়ানো সেই প্রদীপ দা। সেই তৃণমূল আমলেও একভাবেই ছুটে বেরিয়ে কাজ করা আমাদের সদা ব্যস্ত প্রদীপ দা।  সেই বাবার অসুস্থতার কারনে বড়ো সংবাদ মাধ্যমে কাজ না করেও...

আমার স্যার কাজীদা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।  কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।  কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ স...

কুড়ি থালা দশ টাকা আর রসিক মুলুর জীবন

নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।  ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।  একে অপ...

শুভ মকর সংক্রান্তি

মকর মানেই নতুন জামা কাক ভোরে স্নান, রাত্রি জেগে মিঠে সুরে টুসুমণির গান। মকর মানেই পিঠে - পুলির গন্ধে ম - ম হাওয়া, ডুলুং পাড়ে টুসুর মেলায় দল বেঁধে যাওয়া। মকর মানেই মোরগ লড়াই পাহুড় জেতার সুখ, সন্ধ্যা - রাতে মাংস পিঠের স্বাদে ভরা মুখ। মকর মানেই হাতি - ঘোড়ার পুজো করম তলে, সান্ধ্য হাওয়ায় মন উদাসী দিমির দিমির বোলে। আসলে আজ এই মকর সংক্রান্তির দিন, টুসু মেলার দিন, টুসু গানে নিজেকে মাতিয়ে দেবার দিন। অজয় এর ধারে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় ভীড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেবার দিন। অজয় এর জলে ডুব দিয়ে স্নান করে পূণ্য অর্জনের দিন। আর নদীর ধারে মোরগ লড়াই এর দিন। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, সুতো লাটাই হাতে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার দিন। কেমন যেনো রাশির একটি স্থান থেকে অন্য রাশিতে স্থান পরিবর্তনের দিন। সূর্যের দেবতাকে সকালে উঠে স্নান সেরে প্রণাম জানিয়ে শক্তি সঞ্চয় এর দিন। সূর্যের উত্তর দিকে চলে যাবার দিন। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাওয়ার দিন।  এই মকর সংক্রান্তি এর ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড় রয়েছে। এটি কৃষি চক্র এবং ফসল কাটার মৌসুমের সাথে জড়িত। এই মকর সংক্রান্তি চ...