ফাঁকা ঘরের মধ্যে শুন্য অ্যাকোরিয়াম। জলহীন।
মাছহীন। জীবনহীন। উচ্ছাসহীন। অনিন্দ্য অনবদ্য আনন্দহীন একটা পড়ে থাকা ছোট্টো অ্যাকোরিয়াম। শুকনো খটখটে কিছু নকল গাছপালা ঘেরা একটা নকল জগৎ। যে জগৎ এর সবটাই কেমন নকল যেনো আসল শুধু ওর উপস্থিতিটাই। নকল ভালবাসাহীন একটা মায়া আর মমতাহীন একটা জগৎ। যে জগতের বাসিন্দারা হারিয়ে গেছে বহুদিন আগেই আমার এই আঁকিবুঁকিময় জীবন থেকে।
বছর কয়েক আগেও কত সুন্দর নানা রংয়ের জীবন ঘুরে বেড়াতো এই আমার সাজানো চৌকো বাক্সের ভিতর। তারা সবাই খেলা করতো। একে অপরের পিছনে লাগতো। এ ওকে ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মারতো। দৌড়ে বেড়াতো। তারা ওপর নীচ করতো। ঘুরে বেড়াতো। লেজ নাড়তো। আর রাতের বেলায় নীল নরম আলোর স্পর্শ গায়ে মেখে আনন্দে বেঁচে থাকতো, তারা জলের বুদবুদ গায়ে মেখে স্নান করে। একে অপরের সাথে গা ঘষাঘষি করে দিব্যি বেঁচে থাকতো তারা। হেসে, খেলে, ঘুরে বেড়িয়ে, ছুটে চলে আবার কখনও ক্লান্ত হয়ে।
রাতের খাবার দিলেই তারা সবাই কেমন আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়তে ভালবাসত খাবার খেতে। আর যে ঝাঁপিয়ে পড়া দেখে মন ভালো হতো আমার। আজ সব কেমন যেন শূন্য হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ। আমাদের এই গোটা জীবনটাই কেমন যেনো ঠিক ওই অ্যাকোরিয়ামের মতোই হয়ে গেছে। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় এখন শুধুই চারিদিকে পুরোনো ইট কাঠ পাথরের কংক্রিকেটের জঙ্গল আর সেই জঙ্গলের মাঝে সব কেমন ছোট্টো ছোট্টো অ্যাকোরিয়ামের মতই এক কামরা, দু কামরা, বড়ো জোর তিন কামরার ছোট্ট ছোট্ট বন্ধ দরজার ফ্ল্যাট। যেখানে মাপা সংসার। মাপা ভালোবাসা। মাপা সম্পর্ক। মাপা গোনা গুনতি লোকজন। মাপা হাসি। মাপা সাদা প্লেটে খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে মেপে মেপে খেয়ে বেঁচে থাকা।
আর সেই মাপা হিসেব করা জগতে যার মধ্যে এলোমেলো হয়ে ঘুরে বেড়ানো, হেসে বেড়ানো, কিছু হাত পা ওলা, লেজ নাড়া মানুষের দল। কেউ বাবা সেজে, কেউ মা সেজে, কেউ সন্তান হয়ে, কেউ পিসির রূপে, কেউ ভালোবাসার মাসি, কেউ দাদু, কেউ দিদিমা। কেউ কাকিমা, কেউ আবার রাগী মুখের জেঠিমা হয়ে ঘুরে বেড়ানো। ঠিক যেনো ওই এঞ্জেল, গোল্ডফিশ, শার্ক, বেট্টা, ফেদার, লাল মুখো মাথায় ঝুঁটি ওলা মাছ এর মতোই। কেউ বুড়ো হয়ে একটু কম দৌড়য়, কেউ আবার একটু জোয়ান হয়ে বেশী দৌড়ে বেড়ায়। আর সেই সবের মাঝেই একা ঘরের মাঝে পড়ে থাকে শূন্য ওই অ্যাকোরিয়াম।
মানুষের জীবনটাই কেমন যেন একটা অ্যাকোরিয়ামের মধ্যে বন্দী। কখনও হাসি, কখনও কান্না, কখনও আনন্দ, কখনও দুঃখ, কখনও নীল আলোর রোশনাই গায়ে মেখে দৌড়ে বেড়ানো, আবার হঠাৎ করেই কোনো সময় স্থবির হয়ে যাওয়া। এইসব নিয়েই তো আমাদের গোটা একটা জীবন। যে জীবনের স্থবিরতা নেমে আসে একদিন হঠাৎ করেই। অন্ধকার নেমে আসে এই আলোকজ্বল জীবনে।
আলোকময় উজ্জ্বল জীবন থেকে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করা হঠাৎ করেই। এক অন্ধকার জগৎ, যে জগতের বাসিন্দা না হলে বোঝা যায় না কেমন সেই জগৎ। আনন্দের না দুঃখের। কষ্টের না যন্ত্রণার। ভালোলাগার না, আবেশে আনন্দে চোখ বুজে যাওয়া একটা জগৎ। নাকি শুধুই অন্ধকারে বন্দী হয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো একটা অনুভবহীন একটা জগৎ।
যেখানে নামহীন, অস্তিত্বহীন, পরিচয়হীন, স্বজনহীন, বন্ধুহীন, মাতৃহীন , পিতৃহীন, সন্তানহীন হয়ে ঘুরে বেড়ানো একটি গোটা বন্দী জীবন। যে জীবন বড়ো দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। অ্যাকোরিয়ামে বন্দী এই সুন্দর সুদৃশ্য জীবন বড়ো দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। ছায়াপথ ধরে, নীহারিকার রাস্তা ধরে, নক্ষত্রের আলোকপথ ধরে জীবন কেমন যেনো থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। আর দুর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আয়, আয়, চলে আয়। বন্ধ অ্যাকোরিয়ামের ঢাকনা খুলে বেরিয়ে চলে আয়।
কেমন আমার মনের মাঝে বড়ই সাধ হয় ঢাকনা খুলে বেরিয়ে পড়তে। ঘুরে বেড়াতে অন্ধকারময় জগতে একা একা। যে জগতে বিচরণ করছে আমার হারিয়ে যাওয়া মা। যে জগতে বিচরণ করছে ভোর বেলায় হারিয়ে যাওয়া সেই হাসি মুখের দাদু। যে জগতে বিচরণ করছে আমার দিদা। যে জগতে বিচরণ করছে আমার বড়ো মামা। সেই আমার হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট বোন মিস্টু। সেই চেনা পাড়ার মেয়ে ঝুমা। সেই ক্যারাম খেলায় ওস্তাদ এঁদো পুকুরের পাড়ার বন্ধু ভোঁদা। সেই বরানগরের ভালোবাসার পিসি। আরও কতজন।
মাঝে মাঝেই রাতের অন্ধকারে আচমকা একা একাই কেনো জানি না অ্যাকোরিয়ামের ঢাকনা খুলে আমার বেরিয়ে পড়তে বড়ই ইচ্ছা হয় আজকাল। চাঁদনী রাতের মিষ্টি আলো গায়ে মেখে, নক্ষত্রের পথ ধরে, নিহারিকাময় জীবনের রাস্তা ধরে হেঁটে বেড়াতে বড়ো সাধ হয় আমার। সেই চেনা গ্যালাক্সির পথে যদি দেখা হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায় কোনও ভাবে হারিয়ে যাওয়া কোনোও মানুষের সাথে। হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের আলো গায়ে মেখে কোনও একজনের সাথে তাহলে কি ভালো যে লাগবে আমার। সত্যিই জীবন বড়ই মায়ার।
অ্যাকোরিয়াম - অভিজিৎ বসু।
উনিশ জানুয়ারী, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন