এই গল্প রং মাখা দুই শৈশব এর গল্প। এই গল্প পার্বতী আর কিরন নাম এর পিঠোপিঠি দুই দিদি আর বোনের মেঠো জীবনের সংগ্রামের গল্প। যে গল্পের গহন গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে আছে সাদা জীবনের কাল কথার ডোরাকাটা নানা কালো রংয়ের ছোপ ছোপ দাগ। যে কালো দীঘল দাগ ছোটো দুই শৈশবের কচি জীবনে কেমন সত্যিই যেনো একটা গভীর দাগ ফেলে দিয়েছে এই ছোটো বয়সেই। যে অমলিন সম্পর্কের বন্ধন নিয়ে ওরা দুজন কেমন যেন হাসি মুখেই বেঁচে আছে কাউকে পরোয়া না করে, কাউকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মত করেই।
যে বন্ধনের নিগূঢ় সম্পর্ক কেমন একে অপরকে আঁকড়ে ধরে, জড়িয়ে ধরে বেঁচে আছে ঠিক একদম বড়ো মানুষের জীবনের মতই খুব ছোটো হয়েও। ওদের সেই কচি রং মাখা উজ্জ্বল মুখের ছবি, আমার মুখের দিকে ওদের নির্নিমেষ স্থির দৃষ্টির নরম চাওনি, দু হাত পেতে পয়সা চেয়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করা। সবকিছুই যেনো কেমন একটা আলাদা অনুভূতি এনে দেয় আমায় এই বুড়ো বয়সেও। যে অনুভূতিহীন এই বেবাক মানুষটাও কেমন বিহ্বল হয়ে যায় সোনাঝুড়ির সোনাঝরা হিমেল সন্ধ্যায় এদের হুটোপুটি আর বাঁচার জন্য এমন দৌড় দেখে।
সত্যিই তো এমন জিনিস দেখবো ভেবে তো আমি আসিনি এই খোয়াই এর হাটে। ঘুরতে ঘুরতে খালি পায়ে ওকে দেখেই কেমন যেন ভালো লেগে গেলো আমার বেশ। দাঁড় করালাম আমি ওকে ডেকে। সাদা জামার ওপর লাল শাড়ি কোন রকমে জড়ানো, ঠিক যেনো কচি শৈশবকে শাড়ির আঁচলে জড়িয়ে ওর অনেকটাই বড় হয়ে যাওয়া এক ধাক্কায়। ওর মুখের সেই হারিয়ে যাওয়া চেনা হাসিটা লেগেই আছে ওর ঠোঁটের কোণে। ওর চোখের তারায় কালো হরিণ নয়না হরিণীর স্থির দৃষ্টির লাজুক নরম চাওনি। আমার বুকের মাঝে ছুরি চালিয়ে কে যেনো রক্তাক্ত করলো আমায় এই শীতের হিম মাখা সন্ধ্যায়। ওর কপালে চন্দনের শুকনো ফোঁটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবু কেমন ওকে নাম জিজ্ঞাসা করতেই একগাল হেসে ও উত্তর দেয়, আমার নাম পার্বতী গো, পার্বতী।
সত্যিই অসাধারণ লড়াই এর জীবন এই ছোট্টো পার্বতীর। সে দিদি বলে কথা। কত দায়িত্ব তার। তাও আবার পার্বতীর জীবন বলে কথা। জামবুনি থেকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে চান করে সেজেগুজে ওদের রেডি হয়ে যাওয়া। নিজে রং মেখে সেজে আর বোনকে সাজিয়ে নিয়ে একপেট খিদে নিয়ে ওদের বেরিয়ে পরা ঘর থেকে। পায়ে হেঁটে যেতে হবে অনেকটা যে পথ। বোন কিরন অনেক ছোট যে। সাজতে চায়না সে এক মনে, খালি দুষ্টুমি করে যে সে।
কতই বা বয়স তার। ছয় কি সাত দশ এর কোটা পার হয়নি সে এখনও। আর সেই অপু আর দূর্গার কথা না জেনেই পার্বতী ঠিক অপুর মতোই কিরণকে অনেক বকেঝকে বলে, চল চল দেরী হয়ে যাবে যে। দিদি আর বোন রাধা আর কৃষ্ণ সেজে ওদের দুজনের বেরিয়ে পড়ে সোজা চলে আসা এই সোনাঝুড়ির হাটে গাছের নিচে। বাঁশি হাতে ছোট্টো কৃষ্ণ আর রাধা সেজে লোকের কাছে হাত পেতে রোজগার করা দুজনের।
পার্বতীর বাবা যে সকাল হলেই কাটারি, বটি আরও নানা লোহার জিনিস ধার দিতে বেরিয়ে পরে অনেক দূরে দূরে সাইকেল চালিয়ে। মা বেরিয়ে পরে কাজ করতে। অল্প দিন স্কুলে গিয়ে অ, আ, ই, ঈ লিখতে জানে পার্বতী ভালই। কিন্তু না তারপর আর তার স্কুলে যাওয়া হয়নি যে কোনো দিন। স্কুলে গেলে তো আর টাকা মেলে না তার। তাই স্কুল বন্ধ করে দিয়ে টাকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়া দিদি আর বোনের। শীতের সন্ধ্যায় সে মাটিতে বসেই একমনে লিখে যায় স্বরবর্ণের প্রথম চারটি অক্ষর লালমাটির ধুলো পড়া রাস্তায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে। আর আমায় দেখিয়ে বলে এটা অ। এটা আ, এটা ই আর এটা ঈ। ঠিক যেনো বড়ো দিদির মতই সে মাস্টার আর আমি তার ছাত্র।
আমি চুপ করে ওর লেখা দেখি। ওকে জিজ্ঞাসা করি সারাদিনে আয় কত হয়, লিখতে লিখতে ঘাড় গুঁজে উত্তর দেয় আড়াইশো টাকা আজ হয়েছে তার। কি খেলি তুই। কেন সবজি ভাত পঞ্চাশ টাকার ওই যে বিক্রি করছে রাস্তার পাশে বলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেয়। তুমি একটা পান খাওয়াবে আমায় খুব ওই মিষ্টি পান খেতে ইচ্ছা হয় আমার। আমরা নিলে দশ টাকায় পান দেবে। পকেট থেকে বের করে দশ টাকা দিয়ে জিজ্ঞাসা করি আমি তোর বোন কই রে। ওই তো বসে আছে দূরে মাটিতে বসে আছে বাঁশি হাতে পয়সা গুনছে সে। আমি ওর কাছে এগিয়ে যাই। হারিয়ে যায় পার্বতী।
কত যে রঙ মাখা কচি মুখের ভীড় এই সোনাঝুড়ির হাটে ঘুরে বেড়ায় কে জানে। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো সেই বনপাস, ভেদিয়া বা কোপাই আর জামবুনি থেকে আসা কচি শৈশবকে সাথে নিয়ে ছোটো ছোটো পায়ে ওদের বেরিয়ে পড়া। পেটের টানে রং মাখা শৈশবকে আঁকড়ে ধরে ওদের বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। দিন শেষে আঁধার নামে খোয়াই এর প্রান্তরে।
অন্ধকার খোয়াই এর ধূসর হাটে কত রঙিন উজ্জ্বল কচি মুখের সারি। বাউলের উদাস করা সুর মন যে মজেছে আমার ওই রঙের মেলায়। বাঁশি হাতে কিরণের অবাক করা চাওনি। আর পার্বতীর তার বোনকে তাড়া দেওয়া চল চল সন্ধ্যা হলো ঘরে ফিরে রং মুছতে হবে যে। রং মাখা জীবনকে যে ঘষে ঘষে অনেক কষ্ট করে বিবর্ণ রংহীন করতে হবে তাদের দুজনকে। একদম বিবর্ণ রং হীন একটা জীবন। যে সাদা কচি জীবনে কালো ডোরা কাটা দাগ আর একদম থাকবে না।
খোয়াই এর হাটে রং মাখা শৈশব - অভিজিৎ বসু।
আটাশ জানুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন