সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পাশাপাশি দুটি বাড়ি

দুটো বাড়ি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে সেই কবে থেকে কতদিন ধরে কত বছর ধরেই। একদম পাশাপাশি বাস ওদের দুজনের। জড়াজড়ি করে ভালোবেসে একে অপরকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকা ওদের কত বছর ধরেই। দুটি বাড়ি। দুটি জমি। দুটি পরিবার। দুটি ঘর। দুটি সংসার। একে অপরকে ভালোবেসে দুটি করে চারটি মন। সেই মনকে কেন্দ্র করেই বেড়ে ওঠা আরও কত মানুষজন। আর সেই মানুষজনের কলরবে সেই ভরপুর দুটি নতুন জড়োয়ার উত্তাপ মাখা ভালোবাসার সংসার। আনন্দের সংসার। এই বাড়ি ওই বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে অনুমতিহীন প্রবেশ করার হৈ চৈ আর হুল্লোড় করা সংসার। 

হাসি আর কান্না, প্রেম আর বিরহ। মৃত্যু আর যন্ত্রণা। ভালোবাসা আর দূরে সরে যাওয়া। বন্ধুত্ব আর শত্রুতা। আরও কতো কী যে জড়িয়ে আছে, ছড়িয়ে আছে, বেঁধে আছে এই দুই বাড়ির গায়ে সেটা আর বলে বোঝানো যাবে না কিছুতেই। আজ যেনো বড়ো ফাঁকা মনে হয় এই দুটি বাড়ি।

সেই একসাথে দুই বন্ধুর পথ চলা শুরু কবে থেকে জানা নেই আর। সেই একসাথে দুই বন্ধুর হাতে হাত ধরে জীবনের রাস্তায় হাঁটতে নেমে দৌড়ে বেড়ানোর শুরু কবে থেকে মনেই পড়ে না আর। সেই দুই বন্ধুর একসাথে লড়াই করার শুরু। সেই কারখানার আগুন থেকো মালিকের বিরুদ্ধে লড়াই করা শুরু। সেই কারখানার গেটে লে অফ হবার পরে বাঁচার জন্য একটা রুটি দুজনে ভাগ করে খেয়ে লড়াই করা শুরু। সেই দুই বন্ধুর একবাড়িতে রান্না করে ভাতের ম ম গন্ধে ভরপুর ফাঁকা উঠোনে বেঁচে থাকার লড়াই করা শুরু। ঝমঝম বৃষ্টির দুপুরে ভিজে লড়াই করা শুরু। সত্যিই যে লড়াই, যে ভালোবাসা, যে অধিকার, যে সলজ্জ সংসার, সব কিছুই যেনো কেমন করে ভেঙে যায় হঠাৎ করেই কাউকে কিছুই জানান না দিয়ে। 

ফোনটা এসেছিল ঠিক বিকেল বেলায় বাবার কাছে। দুই বাড়ির উল্টোদিকের বাড়ী থেকে। সেই সেজমার বড়ো ঘরে বিয়ে করা বড়ো মেয়ে রূপাদির ফোন করে বলা। কাকাবাবু শুনেছেন তো আপনি খবরটা। বাবার গলায় একটু কি মন খারাপ আর কষ্টের ছোঁয়া ধরা পড়লো। কে জানে পাশের বাড়ী অসীম কাকু মারা গেছেন। বাবার উত্তর, হসপিটালে ভর্তি ছিল জানতাম। কলকাতায় পাঠানোর ভাবনা হচ্ছিল শুনলাম। রাতে খুব বেড়াল ডাকছিল। কত দিন এর স্মৃতি, বন্ধুত্ব, জড়তা, ভালোবাসা, বৈরিতার সব শেষ। একটা ফোনেই একটা খবরেই সব শেষ।

সত্যিই অসাধারণ এই জীবনের নানা অধ্যায়ের মাঝে মৃত্যুর ঘটনা একদমই অন্য এক অনুভূতি এনে দেয় আমাদের মধ্যে। কত ভাব ভালোবাসা, আনন্দ, বিরহ, প্রেম, কাতর কন্ঠের আবেদন। দুই জমির মাঝে পাঁচিলের ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে যাওয়া সম্পর্কের নিনড় বাঁধন, কেমন করে যেন কঠিন কঠোর হয়ে যায় একটা সময় দুই বাড়ির অজান্তেই। দুই ঘরের পাঁচ ইঞ্চির দেয়ালের মাঝে শুধুই ঘুরে বেড়ায় সাদা টিকটিকি আর অবিশ্বাস। যে বন্ধন ছিল গঙ্গা মাটির মতই নরম তুলতুলে সেই সম্পর্কও কেমন করে যে শুধুই কঠিন হয়ে পড়ে শুধুই মান আর অভিমানের ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে কে জানে।

জীবন বেশ অদ্ভুত। জীবনের এই ভালোবাসা, কাছে আসা। একজনের অপরকে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকা। আর পরক্ষণেই আবার কখনও সেই জীবনেই দূরে সরে যাওয়া, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, হঠাৎ করেই বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যাওয়া। সত্যিই ভারী অদ্ভুত এই কঠিন কঠোর গদ্যময় এই জীবন। যে জীবনের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ সত্যিই যেন ঝলসানো রুটি। যে রুটি ভাগ করেই বেঁচে থাকা দুটি পরিবার কেমন করে যেনো আলাদা হয়ে দূরে সরে গেছে নিজেদের অজান্তেই একে অপরের থেকে। কাছাকাছি, পাশাপাশি,ঘেঁষাঘেঁষি করে থেকেও কেমন যেন দূরে সরে থাকা, অনেক অনেক দূরে শতেক যোজন দূরে বাস করা।

আর তাই আজ সেই একজনের মৃত্যুর খবর পেয়েও কেমন অবিচল থাকার চেষ্টা করা মাত্র। মৃত্যু তো তার ঘরেও এসেছিল চুপিসারে একদিন হঠাৎ করেই। কই সেদিন তো কিছুই মনে হয়নি তাদের। তাহলে আর কিসের জন্য এত কষ্ট পাওয়া। যন্ত্রণা পাওয়া। বিদ্ধ
 হওয়া। চিন্তা করা। আকুল হয়ে যাওয়া। শুধু এই একটি খারাপ খবর পেয়ে। 

এই গভীর নিশুতি রাতে পাশাপাশি দুটি বাড়ি একে অপরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চুপ করে তাকিয়ে আছে। পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদের নরম আলো ওদের গায়ে মেখে নিয়ে কেমন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। যে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে অনেক কিছুই। যে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে সেই গভীর গোপন সম্পর্ক আর ভালোবাসার স্পর্শ। যে আলোয় আলোময় হয়ে মায়ার পথ ধরে সংসার ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে দুই বাড়ির দুটি ভালোবাসার মানুষ।

 আর তাই এই রাতের অন্ধকারে পলেস্তারা খসে পড়া দুই বাড়ির গায়ে লেগে আছে কতই না স্মৃতির উত্তাপ আর ভালোবাসার মানুষ এর স্পর্শ। যাদেরকে আর পাওয়া যাবে না কোনোদিন। যাদেরকে আর ধরা যাবে না কোনোদিন। যাদেরকে আর দেখা যাবে না কোনো দিন। সেই আলোর পথ ধরে ভালোবাসার সম্পর্কের মানুষগুলো কেমন করে যেনো হারিয়ে গেছে সেই দূরে অনেক দূরে, সেই অজানা আলোর রাজ্যে। পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদের আলো গায়ে মেখে বেঁচে আছে দুই বাড়ি। 

পাশাপাশি দুটি বাড়ি - অভিজিৎ বসু।
তেসরা ফেব্রুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

জামালপুরের প্রদীপ দা

আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় বর্ধমানের জামালপুরের সেই দাপুটে ঠোঁট কাটা সাংবাদিক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এর কথা। সেই বিখ্যাত সুভাষ তালুকদার এর কাগজ সংবাদে মাত্র এক টাকার কাগজে কাজ করা সংবাদ পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক সেই প্রদীপ দা। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বাঁশের ব্যারিকেডের এপারে দূরে দাঁড়িয়েও যে খবর করা যায় সেটা বড়ো মিডিয়ার সাংবাদিকদের হাসি মুখে দেখিয়ে দিয়ে, আর তাদের খবরের ময়দানে গোল দিয়ে শুধু খবরকে ভালোবেসে ছোটো কাগজে কাজ করে চলা সর্বদা হাসি মুখের সেই আমাদের প্রদীপ চ্যাটার্জী দা।  কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে যাওয়া আর এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়া ঝোলা কাঁধে সেই খবরের খোঁজে সেই জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রদীপ দা। সেই বিখ্যাত পন্ডিত রবিশঙ্কর আর উদয়শঙ্কর এর আপন মাসতুত ভাই এর ছেলে সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় দাদা। সেই বামদের আমলে জামালপুরের এলাকায় দাপিয়ে খবর করে ছুটে বেড়ানো সেই প্রদীপ দা। সেই তৃণমূল আমলেও একভাবেই ছুটে বেরিয়ে কাজ করা আমাদের সদা ব্যস্ত প্রদীপ দা।  সেই বাবার অসুস্থতার কারনে বড়ো সংবাদ মাধ্যমে কাজ না করেও...

আমার স্যার কাজীদা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।  কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।  কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ স...

কুড়ি থালা দশ টাকা আর রসিক মুলুর জীবন

নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।  ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।  একে অপ...

শুভ মকর সংক্রান্তি

মকর মানেই নতুন জামা কাক ভোরে স্নান, রাত্রি জেগে মিঠে সুরে টুসুমণির গান। মকর মানেই পিঠে - পুলির গন্ধে ম - ম হাওয়া, ডুলুং পাড়ে টুসুর মেলায় দল বেঁধে যাওয়া। মকর মানেই মোরগ লড়াই পাহুড় জেতার সুখ, সন্ধ্যা - রাতে মাংস পিঠের স্বাদে ভরা মুখ। মকর মানেই হাতি - ঘোড়ার পুজো করম তলে, সান্ধ্য হাওয়ায় মন উদাসী দিমির দিমির বোলে। আসলে আজ এই মকর সংক্রান্তির দিন, টুসু মেলার দিন, টুসু গানে নিজেকে মাতিয়ে দেবার দিন। অজয় এর ধারে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় ভীড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেবার দিন। অজয় এর জলে ডুব দিয়ে স্নান করে পূণ্য অর্জনের দিন। আর নদীর ধারে মোরগ লড়াই এর দিন। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, সুতো লাটাই হাতে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার দিন। কেমন যেনো রাশির একটি স্থান থেকে অন্য রাশিতে স্থান পরিবর্তনের দিন। সূর্যের দেবতাকে সকালে উঠে স্নান সেরে প্রণাম জানিয়ে শক্তি সঞ্চয় এর দিন। সূর্যের উত্তর দিকে চলে যাবার দিন। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাওয়ার দিন।  এই মকর সংক্রান্তি এর ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড় রয়েছে। এটি কৃষি চক্র এবং ফসল কাটার মৌসুমের সাথে জড়িত। এই মকর সংক্রান্তি চ...