আমারও ইদানিং ঠিক সেই অবস্থাই হয়েছে। সারাদিন ঘরে শুয়ে, বসে, পাশ ফিরে, কাত হয়ে, এদিক আর ওদিক করে, কড়ি বরগার দিন গোনার কাজ শেষ হয়েছে কবেই। দেশলাই বাক্সের ভিতর পর্দা ঘেরা ছোটো খুপড়ির ভিতর বাস করে, আর মাঝে মাঝেই উল্টোপাল্টা লেখালেখি করে সময় যেনো কাটতেই চায় না আর কিছুতেই আমার। আর ঠিক তার ওপর সন্ধ্যা হলেই মনটা কেমন যেনো নিশির মতই ডাকে আমায় এদিক ওদিক। সেই গরম লাল গনগনে উনুন ধরানোর পালা সাঙ্গ হয়েছে কবেই সেই ক্রিকেটার সঙ্গকারার আমলেই। তবু সেই সবুজ দ্বীপের রাজার দেশে সিনেমার মতই সেই লাল গনগনে আগুনের গোলার মতোই টান যেনো একটা জাগে আমার। এখন তো আর সেই সব কিছুই নেই। তবু সন্ধ্যায় সেই ঝুড়ির ওপর ফুলুরির হাসি মুখ দেখতেই কেমন করে যেন হেঁটে হেঁটে চলে যাওয়া বাড়ী থেকে বেরিয়ে একা একাই নিশির টানে নয় ফুলুরির টানে।
শ্রীরামপুরে বহু বছর আগে সেই স্টেশনের কাছে শিবুদার দোকানে ফুলুরি আর চপ এর দোকান ছিল একসময়ে বেশ জমজমাট। অফিস ফেরত লোকজন ঘরে ফেরার পথে চপ, ফুলুরি নিয়েই ঘরে ফিরত হাতে করে। তখনও বাজারে সুন্দরী স্লিম ডানা কাটা পরীর মতই মোমো সুন্দরীর উদয় হয়নি। সেই সুন্দর রং বেরঙ এর চামচ, লাল টুকটুকে ঠোঁটে আলতো করে ঠেকিয়ে স্যুপ খাবার চল শুরু হয়নি তখনও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে সেজেগুজে গায়ে দামী অদামী সেন্ট ছড়িয়ে। ফুচকা ছিল সেই সময় ঠিক যেনো নতুন বউ এর মতই ঘোমটার আড়ালে একটু লাজবতী কন্যার মতই কম দেখা এক খাবার জিনিস মাত্র।
আর সেই সময়ে খালি গায়ে জবজবে ঘামে ভেজা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে একমনে কাঠি দিয়ে আর বড়ো লোহার ছাঞ্চা দিয়ে চপ আর ফুলুরি ভাজতেন শিবু মামা দ্রুত হাতে। বাবাকে সাহায্য করত সেই সময় তিন ছেলে হারু, শ্যামল আর বুড়ো। সেই আজ থেকে কত বছর আগেই তো এই ফুলুরির দোকান ছিল স্টেশনের কাছেই। শিবু দা চলে গেলেন তিন ছেলের সংসার হলো। জোড়া লাগা সংসারে ভাঙনের চিহ্ন ফুটে উঠলো ধীরে ধীরে ঠিক যেনো আমগাছের শিকড় ছড়িয়ে পড়া দেয়ালের ভিতর। একে একে এক হাঁড়ির ভাত তিনহাঁড়ি হলো বেশ দ্রুত লয়ে। ঠিক যেনো কাহারবা নয় দাদরা বাজাও এই লয়ে। সেই শোন হে শশীকান্তর মত করে। হারু বাবার মান রেখে চপ আর ফুলুরি ভেজেই সংসার টানে এখন। বাকি দুজন একজনের তো মোবাইল ফোনে নানা ধরনের জিনিস এর দোকান। শ্যামল এর দোকানেও টুকটাক জিনিস বিক্রি হয় নানা ধরনের জিনিস। কিন্তু সেই চপ আর ফুলুরির দোকান বন্ধ সেই কবে থেকেই স্টেশন এর কাছে। শিবুদার দোকান আজ অতীত ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে কবেই।
পাড়ার এক জ্যাঠাইমা তো এক থালা ভাত খেতেন নাকি সামনে একটা ফুলুরি রেখেই। শুধু দেখে দেখেই তাঁর খাওয়া হয়ে যেতো নুন আর লংকা আর তেল দিয়েই। আমিও তাই সন্ধ্যা বেলায় ফুলুরি খেতে হাজির হলাম শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে সেই নেতাজী সুভাষ এভিনিউ এর রাস্তার পাশের একটি ছোট্ট দোকানে। রাস্তায় মেলা ভীড়। তবু এই প্রেমের মিষ্টি ফাঁদে আটকে যাওয়া শহরেও কেমন যেন চপ আর ফুলুরির টানেও ভীড় উপচে পড়ছে এই ছোট্টো দোকানেও ধোঁকা, নবরত্ন চপ, পাঁউরুটি দিয়ে ভাজা চপ, টমেটোর চপ নানা জিনিসের সমাহার। সবটাই নিরামিষ আহার কিন্তু।
ছোট্ট দোকানে মা, ছেলে আর বোধহয় ছেলের বউ এর ব্যস্ততার ভরা সংসার। দোকানের তেলচিটে দেওয়ালে নানা ঠাকুরের মূর্তির মাঝে শুকনো মালা পড়ে আটকে থাকা দোকানের আসল স্থপতির ম্যাড়মেড়ে ছবি। আমিও ভীড়ের মাঝে অপেক্ষায় আছি কখন আসবে প্রাণের ফুলুরি। যা খেতে বোলপুর থেকে শ্রীরামপুরে চলে আসা আমার। সেই সমীর আর আমার এই দোকানে দাঁড়িয়ে ফুলুরি খাওয়া। পাঁচ টাকার একটি ফুলুরি আর দু বা তিন টাকার মুড়ি যদি দেয়। তাহলে সন্ধ্যার টিফিন হলো দশ টাকায়। সাথে এক কাপ ভাঁড়ে চা পাঁচ টাকার। দশ থেকে পনেরো টাকার টিফিন করে ঘুরে বেড়ানো যাবে এই ফ্রেডরিক নগরের বিভিন্ন জায়গায় ভীড় আলো ঝলমলে রাস্তায়। ফুলুরি খেয়ে আর ভাজা ধোঁকা নিয়ে সারাজীবন তো কম ধোঁকা খেলাম না সেটাকে মনে না রেখেই নিঃশব্দে ঘরে ফিরে আসলাম আমি। রাস্তায় দেখা হলো মৌসুমীর সাথে। ওর মেয়েকেও দেখলাম। মা আর মেয়ের নতুন জুটি। ভেঙে যাওয়া তিনজনের সংসারে এখন দুজনের জুটি বেশ দিব্যি মানিয়ে আর মেনে নিয়েছে ওরা। স্টেশনের কাছে পাঁচ টাকার চা কিনে খেয়ে ঘরে ফেরা আমার।
মনে মনে ভাবলাম সামনেই আবার বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। কত শিল্প, কত বিনিয়োগ, কত ঝাঁ চকচকে শিল্পপতির আগমন হবে এই বঙ্গে। যে বাংলায় একদিন শিল্প ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল এক শিল্পপতিকে টাটা করে সেই বঙ্গেই আজ শিল্পের নতুন করে আবাহন। সত্যিই একদম উল্টো চিত্র। সৌজন্যে মা মাটি আর মানুষের সরকার। শুধু তার মাঝে এই সন্ধ্যা হলেই চপ, ফুলুরির সুবাস আমায় কেনো যে মোহিত করে কে জানে। প্রতিদিন কম করে খরচ বাদ দিয়ে হাজার টাকা রোজগার মাসে তিরিশ হাজার। তিনজনের সংসারে মন্দ কি। পাড়ার দাদাকে মাঝে মাঝে তাঁর পার্টি অফিসে একটু ফ্রী জিনিস পৌঁছে দেওয়া। আর প্রতি দিন সন্ধ্যা হলেই ভীড় উপচে পড়া দোকানে গরম চপ আর ফুলুরির সুবাসে মন ভালো করা রোজগার।
বেশ মন্দ নয় কিন্তু। সারাদিন কোনোও কাজ না করে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা কাজ করে বেশ কিছু রোজগার। বৃহৎ শিল্প না হোক ঘরে ঘরে এমন ছোটো ছোটো চপ আর ফুলুরির মিষ্টি সুন্দর শিল্প কিন্তু মন্দ নয় কি বলেন। তাহলে কে বলে বাংলায় শিল্প হয়না। কে বলে বাঙালি কর্মবিমুখ জাতি। কে বলে বাঙালি উচ্ছনে চলে গেছে। কে বলে এই বাংলার মান ক্রমেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। চুপ একদম চুপ। চপ, ফুলুরির সুবাসে সব যে ঢাকা পড়ে গেছে কবেই। পাড়ার চেনা কেলো, ভুলোর দল সন্ধ্যা হলেই ভীড় করে এই ছোটো দোকানে। আর গলা ফুলিয়ে বলে চপ শিল্প যুগ যুগ জিও।
ফুলুরির টানে ফ্রেডরিক নগরে -, অভিজিৎ বসু।
চার ফেব্রুয়ারি দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন