এটা সেই উত্তরপাড়ার রামঘাটের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে স্কুল চালানো একটি ভগ্নপ্রায় বাড়ী আর সেই পরিচিত গোপালদার চেনা অফিস। যে অফিসে সন্ধ্যা হলেই সাইকেল চালিয়ে চলে আসতেন আমাদের সবার প্রিয় গোপাল দা। হ্যাঁ, সেই উত্তরপাড়ার গোপাল চ্যাটার্জী। আমাদের হুগলী জেলার ছোটো কুচোকাচা সাংবাদিক দের ছোটো ছোটো খবর দেওয়া গোপাল দা। সেই প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর হাত ধরে কংগ্রেস করা সেই গোপাল চট্টোপাধ্যায়।
যখন লাল পার্টির দাপটে বিরোধী দল করা বেশ কষ্টের ছিল সেই আমলে গোপাল দা বুক চিতিয়ে হাত কংগ্রেস করতে ভয় পেতেন না একদমই। সেই বর্তমানে বিখ্যাত তখন ওহ লাভলি নেতা মদন মিত্র এত বিখ্যাত ছিলেন না সেই সময়ে সেই আমলে। সেই মদন মিত্র আসতেন এই রামঘাটের অফিসে বেশ সুন্দর করে সেজেগুজে মাথাভর্তি চুলে চিরুনি অভিযান করে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাড়ির সামনে তখন কত ভীড় জমে যেতো মদন দা এলেই। সাদা ঘের ওলা বেলবটস প্যান্ট আর টকটকে লাল টাইট গেঞ্জি পড়ে এখনকার মত এত বিখ্যাত না হয়েও চোখে রঙিন চশমা না পরেও সাংবাদিকদের হাসিমুখে সামলে দিতেন তিনি। বলতেন গঙ্গার ধারের এই জায়গাটা গোপাল বেশ সুন্দর জায়গা কিন্তু তোর জন্য কিছু করতে হবে। না কিছুই করে উঠতে পারেননি তিনি গোপালদার জন্য। গঙ্গার উল্টোদিকে দক্ষিণেশ্বর এর মায়ের মন্দির। আমাদের সেই কতদিনের চেনা মদন দা। যিনি এখন কংগ্রেস ভেঙে ঘাস ফুলের দলে আর দলের মধ্য প্রতিবাদী মুখ মাত্র। কামারহাটির বিধায়ক হয়ে মা ভবতারিণী মন্দির এর একদম মায়ের কোলের বাসিন্দা। সত্যিই দিন যে কত বদলে যায়।
সেই রামঘাটের অফিসের ছবি তুলে আজ সকালেই আমায় পাঠিয়ে দিলো সৌম্য মুখোপাধ্যায়। উত্তরপাড়ার সৌম্য। সেই পিটিআই এর সৌম্য। ওকে মাঝে মাঝেই আমি বলেছি গোপালদার কথা গল্প করতে করতে। সরস্বতীর পূজা উদযাপন হচ্ছে চারিদিকে। বাড়ীতে অঞ্জলি আর শাঁখের আওয়াজ। আর তার মাঝেই এই রামঘাটের ছবি পেয়ে গোপালদার কথা মনে পড়ে গেলো আমার। যদিও গোপালদার কোনো ছবি নেই আমার কাছে আজ আর। নেই সেই বিখ্যাত গোপালদার সঙ্গী অনুপ এর কোনোও ছবিও। উত্তরপাড়ার টেলিগ্রাম অফিসে কাজ করতেন গোপাল দা। সেখানেই তাঁর সাথে কাজ করত অনুপ পোঁড়ে। গ্রাম থেকে আসা শহরে মানুষদের সাথে কাজ করা তাদের চা আর জল দেওয়া একটি গ্রামের ছেলে অনুপকে কাজ দিয়েছিল গোপাল দা। এই রামঘাটের অফিসের অফিস বয়। গোপালদার সর্বক্ষণের সঙ্গী সুখের আর দুঃখের।
সেই উত্তরপাড়ার টেলিগ্রাম অফিসের অফিস সামলানো গ্রুপ ডি কর্মী অনুপ। সেই ওর স্টাইল করা লম্বাহিপি চুল, সেই ওর ষ্টাইল করা ফুল ঝোলানো চকচকে সাইকেল। মদন মিত্রর মতই স্টাইল করা সাদা চটি পড়ে এসে দাঁড়াতো সে গোপালদার ডাক শুনেই। আর বলতো গোপাল দা তোমার নিয়তি এসে গেছে।আর আমরা সেটা শুনে চুপ করে চা মুড়ি খেতে খেতে হাসতাম। আর গোপাল দা ওকে বলতো কি বললি তুই আমার নিয়তি এসে গেছে এই সন্ধ্যাবেলায়। দেখা যেতো নিয়োগী দা আসতেন হাসি মুখে রামঘাটের অফিসে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ধীর পায়ে। যাকে অনুপ নিয়তি বলে অভিহিত করেছে বেশ সুন্দর করেই। বেশ ভালো লাগতো কিন্তু সেই সময় এই ঝাঁ চকচকে তৃণমূল কংগ্রেস এর পার্টি অফিস নয় একটা সেবা মূলক প্রতিবন্ধীদের ছোটো অফিস। তখন বুঝিনি আমরা সত্যিই একদিন নিয়তি এসে যাবে গোপালদার।
তরুন মুখোপাধ্যায় তখন প্রতিদিনের জেলার দাপুটে সাংবাদিক। তরুণদার জনসংযোগ বেশ ভালই। তরুণ দার হাত ধরেই আমার গোপালদার কাছে পৌঁছে যাওয়া। আর সেই মদন মিত্র পন্থী নেতা গোপাল চট্টোপাধ্যায় এর কাগজে নাম বেরোলেই কি খুশি গোপাল দা সেদিন। পকেটে প্রতিদিন কাগজ কিনে চলে আসতেন সন্ধ্যা হলেই এই রামঘাটে। সেদিন ভাল টিফিন এর ব্যবস্থা। চা, মুড়ি আর সিঙ্গারা। কাগজ পেতে মুড়ি খাওয়া। অনুপ এর হাতের ছোঁয়ায় সুন্দর চা খাওয়া। আমাদের এই আড্ডাটা বেশ ভালই ছিল কিন্তু। সেই সময় এই এলাকার কংগ্রেস নেতা তখন সত্যেন যে আবার গোপালদার বিরুদ্ধপন্থী লোক এলাকায়। সেই দিলীপ যাদব ধীরে ধীরে নেতা হবার পথে এগিয়ে চলেছে। যাই হোক তাতে কিছুই ক্ষতি হয় নি মাঝে দু একটা গণ্ডগোল ছাড়া।
এই গোপালদার বাড়িতে ল্যান্ড ফোনে টেলিফোন করলেই বৌদি বাড়িতে ফোন ধরে বলতেন ধরুন দাদাকে দিচ্ছি আমি। সেই বোধহয় ২৬৬৩৫২৭৮ নম্বর ছিলো গোপালদার খুব সম্ভবত। সেই উত্তরপাড়া কোঅপারেটিভ ব্যাংক এর সামনে বাড়ী ছিল তাঁর। গোপালদার মা ছিলেন বেশ রাশভারী মহিলা। এমন নানা স্মৃতি উপচে পড়ছে এই রামঘাটের অফিস এর এই ছবিটা দেখে। সেই উত্তরপাড়ার টেলিগ্রাম অফিস থেকে বদলি হয়ে কলকাতা সিটিও তে চলে যাওয়া তাঁর। সেই ডালহৌসি চত্বরের অফিস এও গেছি আমি। নানা খবর দিয়ে আমাদের মত ছোটো সাংবাদিকদের সাহায্য করতেন তিনি হাসিমুখেই। এলাকার হুগলীর বড়ো রিপোর্টাররা অবশ্য গোপালদাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি কোনোদিন। সেটা নিয়ে তাঁর কোনো আফশোষ ছিল না।
সেই আমার বিয়ের পরে বৌভাতে সকাল বেলায় শ্রীরামপুরে বটতলায় বৌদিকে নিয়ে দেখা করে গেলেন। খুব সুন্দর গিফট দিলেন। মেয়ের মুখে ভাতেও এসেছিলেন মনে হয়। হঠাৎ একদিন শুনলাম গোপাল দা নেই আর। উত্তরপাড়ার গোপাল দা নেই। মারা গেছেন তিনি। না, বৌদির কাছে গিয়ে আর দাঁড়ানো হয়নি আমার সেই বাড়ির সামনে দরজায় ঠকঠক করে। আসলে বৌদিকে আমি আর দেখতেই চাইনি ওই রূপে। সেই মেয়েটা আজ অনেক বড় হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। সেই গোপালদার ছোটো ছেলেটা আজ যুবক। বৌদি একাই নিজে নিজেই কেমন করে সব সামলে নিলেন নিজের জীবনের শোক আর ছেলে মেয়ে পরিবারকে জানা হয়নি আমার আর। জানিনা গোপালদার মার কি খবর।
সেই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রামঘাটের এই বাড়ী, সেই রং চটা বিবর্ণ বাড়ীর গায়ে লেগে থাকা কিছু বিবর্ণ স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আজও। আজ সকালে সৌম্যর দেওয়া সেই ছবি দেখে কত কিছুই না মনে পড়ে গেলো আমার এই সরস্বতী পূজোর দিনে। সত্যিই জীবন বড়ই অদ্ভুত আর স্মৃতিকাতর। হুগলীর কংগ্রেস এর রাজনীতিতে খুব বড়ো জায়গায় না পৌঁছতে পারলেও গোপালদা কিন্তু সিপিএম বিরোধী আন্দোলনে কলকাতার নেতাদের নেতা হওয়ার একটা স্টেজ তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি সেই সময়। যে স্টেজে উঠেই পারফর্ম করে অনেকেই পয়েন্ট পেয়েছেন, জেলা থেকে কলকাতায় ফিরে নেতা হয়ে গেছেন, মন্ত্রী, বিধায়ক হয়ে গেছেন আর সেই উত্তরপাড়ার গোপাল চট্টোপাধ্যায় হারিয়ে গেছেন আমাদের সবার কাছ থেকে। ভালো থাকবেন দাদা। আমার প্রনাম নেবেন।
উত্তরপাড়া রামঘাটের গোপাল দা - অভিজিৎ বসু।
দোসরা ফেব্রুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য সৌম্য মুখোপাধ্যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন