সাড়ে পাঁচশো টাকার বিনিময়ে কলেজের পুনর্মিলন উৎসব। সাড়ে পাঁচশো টাকা আজ আর আমার সারা মাসের আয়ই নয়। পাঁচশো টাকার নোট কেমন দেখতে সেটা আর দেখাই হয়না আমার প্রায় বেশ কয়েক বছর ধরেই নিজের পকেটে। এখন তো আমি সেই বেকার জীবন, টোটো চালকের এলোমেলো, এলেবেলে, আর বিন্দাস জীবন কাটিয়ে যাওয়া একজন হাত পা ওলা বেকার বোকা মানুষ।
যার কোনোও তাড়া নেই, যার কোনও দৌড় নেই, একে অপরকে টপকে যাওয়ার কোনোও চেষ্টাও নেই আর। নিজের ঢাক নিজে পিটিয়ে বলা নেই জনসমক্ষে ভীড়ের মাঝে আমি আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এতো গুলো সিঁড়ি টপকে গেছি। টাই এর নট ঠিক করে আফটার সেভ করা গম্ভীর মুখে বলা সামনের ইনক্রিমেন্ট হলেই আমি টপ, টপ শুধু টপ হয়ে যাবো গোটা অফিসে। সমাজে সংসারে হাটে বাজারে মাঠে ঘাটে আজ আর আমার কোনোও দামই নেই।
একদম চুপ চাপ শুয়ে বসে আলসেমির জীবন কাটানো এই আমি। সেখানে আর আমার বলার ইচ্ছেও নেই যে মিলন হবে কতো দিনে বলে উচ্চস্বরে ভেউভেউ করে গেয়ে ওঠা আর দু হাত তুলে নেচে ওঠা আপনমনে আপনছন্দে। সেখানে সেজে গুজে গায়ে সেন্ট মেখে বুড়ো বয়সে এসে এই লোলচর্মসার হবার প্রতীক্ষার প্রহর গুনে বেশিদিন দিনযাপন এর ইচ্ছাও নেই আর আমার এই ধূলিধুসর পৃথিবীতে। তাই নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করে আবার নিজেকে ফিরে পাওয়া। অতীতকে আঁকড়ে ধরা আর কলেজ জীবনের স্মৃতির জারক রসে জারিত হওয়া। এসব কেমন যেন পানসে লাগে আমার এই প্রায় বুড়ো বয়সে এসে।
তবু নানা টুকরো টুকরো ছবি, সেই গাছের ফাঁকে সাদা বাড়ীর আর থামের অজানা হাতছানি আজও কেমন বিহ্বল করে আমায়। সেই সবুজ মাঠে ফাল্গুনী রোদ এর লুটোপুটি দেখে সবুজ মাঠে শুয়ে পড়তে ইচ্ছা হয় আবার। সেই দূরে গাছের ডালে ফাল্গুনের হাওয়া মাখা বিকেল, তিরতির করে কেঁপে কেঁপে ওঠা পাতা কেমন যেন লজ্জায় রাঙা হয় এতদিন পরেও ঠিক আগের মতোই।
মনে পড়ে যায় সেই পঁয়ত্রিশ বছর আগের একঝাঁক তরুণ ছেলে মেয়ের কথা। সেই নানা স্বপ্ন দেখা আর ভালোবাসার চোখে চোখ রেখে একে অপরকে আঁকড়ে ধরা কিছু জীবন আর হারিয়ে যাওয়া জীবনের কিছু জলছবি। যে ছবি আজ বিবর্ণ প্রায় একদমই। সেই ঘষা কাঁচের জানালায় টুক করে উঁকি মারে হারিয়ে যাওয়া হাসি মুখের উজ্জ্বল প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো সেই তপতী। সেই ভদ্রেশ্বর থেকে আসতো সে কলেজে। ওর মুখটা কেমন যেনো ভেসে ওঠে আবার এতদিন পরেও আমার চোখে। সেই তপতীর হারিয়ে যাওয়া একদিন।
সেই সাইকেল চালিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে বিকেলের রোদ গায়ে মেখে গঙ্গার ধার ধরে বাড়ী ফেরা পিয়াস আর মৌসুমীর কথা মনে পড়ে যায় আমার এতবছর পরেও এই মিলনের দিনে। ওদেরও জুটি ভেঙেছে আচমকাই একদিন। কলেজের সেই চেনা পথে ঘুরে বেড়ায় পিয়াসের সেই হাসি মাখা মুখ আজও কেমন একা একাই। আর কলেজে একা ঘুরে বেড়ায় বুকের মাঝে হাজার কষ্ট চেপে মৌসুমী মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে আনমনে একা একদম একাই।
আর সেই বিখ্যাত ঝুম আর রাজার জুটিও ভেঙে গেলো একদিন কাউকে কিছু না বলেই কোনও নোটিশ না দিয়েই। একা হয়ে যাওয়া সেই দাপুটে সুন্দরী ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ক্লাসে এলো একদিন, পেছনে এলো হাই পাওয়ার এর চশমা পরা উজ্জ্বল মুখের রাজা। আমরা সবাই ওদের দেখলাম সেই এন ডির জুলজীর ক্লাসে অপলক নয়নে। সেই রাজাও কেমন হারিয়ে গেছে এই ফাল্গুনের নিঃস্তব্ধ পাতা ঝরা দুপুরে একদিন হঠাৎ করেই। ওর কথাও মনে পড়ে যায় আমার এই এতদিন পরেও। ঝুম এর ব্যস্ত জীবন এর মাঝে এখন আর রাজা নেই কতদিন হয়ে গেল। বুকের মাঝে কষ্ট চেপে কেমন হাসি মুখে বেঁচে আছে সেও কেমন একা একাই। আরও কতজন যে হারিয়ে গেছে তার খোঁজ নিতে আর ভালো লাগে না আমার ভয় করে বেশ।
সেই যে তিন সত্যিই করে গঙ্গার ধারে বসে সন্ধ্যায় বলা আমি তোমাকেই ভালবাসি। দূরে নাম না জানা পাখি ডেকে ওঠে। সেই গঙ্গার ঘাটে বসে প্রতিজ্ঞা করা একে অপরের আঙুল ছুঁয়ে। দীঘল চোখে চোখ রেখে দুই শালিখের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে এগিয়ে যাওয়া একে অপরের কাছে নির্নিমেষ নয়নে। আর একে অপরকে বলা আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে যাবনা কোনওদিন ভাঙবো না আমাদের এই জুটি।
কিন্তু মিলন মেলার সেই পুনর্মিলনের দিনে আমার যে যন্ত্রণা বাড়ে, এই কলেজের সেই চেনা পথে ঘুরে বেড়িয়ে। আর তাই বোধহয় কিছুটা ভয়ে আর কিছুটা যন্ত্রণা বুকে চেপে আমি আর সেই ভাঙা জুটির মুখো মুখি হতে চাইনা আর কিছুতেই। সেই ভেঙে যাওয়া চেনা জুটি, সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষ আর আমার হারিয়ে যাওয়া কলেজের অতীত জীবন ধরা থাক ঠিক আগের মতই আমার মনের মণিকোঠায় জড়োয়ার বাক্সে রাখা দামী গয়নার মতোই। কি দরকার মিলনের হাতছানিতে ডাক দিয়ে বৃথা যন্ত্রণা বাড়িয়ে এই বুড়ো বয়সে আরও কষ্ট পাবার।
শ্রীরামপুর কলেজের পুনর্মিলন উৎসব - অভিজিৎ বসু।
সতেরো ফেব্রুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন