আজ এক সেলাই করা মানুষের জীবনের গল্প। যে জীবনে জড়িয়ে আছে কত কিছুই। হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখের নানা রং বেরঙ এর নানা অনুভূতি। সব কিছুকে মেনে নিয়েই আর সেলাই বুনেই দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিলেন তিনি আমাদের সবার পরিচিত সেই শ্রীনিকেতন রোডের সেলাই এর কারিগর সেই নবদা। শ্রীনিকেতন রোডের ওপর ভেঙে পড়া একটি ছোট্টো সেলাই এর দোকান। যে দোকানের বয়স প্রায় পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে কবেই দু বছর আগেই। সেই দোকান আর নবদার গল্প আজ সাদা জীবনের কালো কথায় আমার আঁকিবুঁকি ব্লগে।
সেই যখন তাঁর কুড়ি বছর বয়স তখন এই অল্প টাকায় দশ টাকায় বা আরও কমে ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি এই ছোটো দোকানের। আজ থেকে বাহান্ন বছর আগে এই দোকান নেওয়া তাঁর। এই রাস্তার ধারে তখন এত দোকানের রমরমা ছিল না একদমই। সেই সময় এই শ্রীনিকেতন রোডে হাতে গোনা কটি দোকান আর তাঁদের সবাই পরিচিত মুখ। খুব কম মানুষজনের বাস এই রাস্তার ওপর। তাঁর কাছেই বোলপুর হাইস্কুল আর বোলপুর পোস্ট অফিস, একটু দূরেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর বোলপুর কলেজ। সেই একদম কম লোকের এই ফাঁকা বোলপুর শহরে তখন লোকজন একদম খুবই কম বাস করেন। টেলারিং এর দোকান বলতে এই একটাই দোকান।
এই ফাঁকা শহরে তখন তিন চাকার রিকশা চললেও হাজার হাজার টোটো চালিয়ে পঙ্খিরাজদের ঘুরে বেড়ানো দেখা যেত না একদমই। শ্রীনিকেতন মোড় পর্যন্ত একদম ফাঁকা রাস্তা, দু ধারে গাছের সারি দেখা যেতো দুর থেকে। এত ধুলোর আস্তরণ পড়তো না দু বেলা রাস্তার ওপর। দোকানে জমতো না ধুলোর পলেস্তারা। আর সেই যুবক নবদা তখন এই সেলাই এর দোকান খুলে জামা প্যান্ট তৈরীর কাজ শুরু করলেন। বেশ ভালই লাগত তাঁর সেই কাজ করতে। একদিকে নতুন সংসার, মেয়েদের পড়াশোনা করানো, সংসার চালানো সব কিছুই চালাতে হতো এই সেলাই মেশিন এর মাধ্যমে হাতের কাজ করে। জামা প্যান্ট আর কিছু স্কুল এর ড্রেস তৈরি করতেন তিনি। হাতের কাজ এর দৌলতে সেই নতুন কাপড়ের ওপর কাঁচি চালিয়ে কাটিং করে দিব্যি সংসার চলে যেতো তাঁর বেশ ভালই।
আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় সেই নবদার কথা। সেই কাজের ফাঁকে টুক করে পকেট থেকে খৈনির কৌটো বের করে একটু তৈরি করে নেওয়া চুপিসাড়ে। এই নেশা যে বড়ো জ্বালায় তাঁকে এই বুড়ো বয়সেও। নবদার দোকানে আড্ডা দিতে আসা অবসর গ্রহণ করা সব নানা মানুষজন সন্ধ্যা হলেই ভীড় করেন তাঁরা এই রং চটা দোকানে। কেউ হয়তো নবদার তৈরি খৈনি খেতে আর একটু পুরোনো দিনের আড্ডা দিতে আসা তাঁদের। কেউ আবার সেই ১৯৭৬ সাল থেকেই এই দোকানের জামা প্যান্ট পরেই গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন তিনি। এক সময়ের বড়ো পদে ডিভিসিতে চাকরি করা অফিসার হলেও নিজের শহরের এই পুরোনো দোকানের ঠেক আর আড্ডাকে ভুলতে পারেন না একদমই। ভুলতে পারেন না বহু পুরোনো দিনের বন্ধু নবদাকেও। এই শহরের বহু পুরোনো দিনের বনেদী পরিবার তাঁদের। আর নবদা একমনে মেসিন চালিয়ে যায় আর গল্প করেন সেই পুরোনো দিনের কথা বলেন আমায়।
দোকানের উল্টো দিকের বাড়ী ভাঙা হচ্ছে সেটাও কি বহুতল ভবন হবে, নবদার উত্তর না অনেক বড়ো বাড়ী এদিক ওদিক লোককে ডাকলে কেউ শুনতে পেতোনা তাই তো এই বড়ো বাড়ী ভেঙে ফেলে ছোটো বাড়ী হবে এই বাড়ীর বয়স তো প্রায় ১২৮ বছরের। বাবা ছেলেকে ছোটো বাড়ী করে দেবেন যাতে অসুবিধা না হয় এক দম ছেলের কোনও। তিনি বলেন ডাক্তার এর নিষেধ থাকলেও তিনি এই খৈনির নেশা আজও ছাড়তে পারেননি যে সেটা খান একটু আধটু কাজের ফাঁকে। এই শহরের বহু পুরোনো দিনের চিকিৎসক তাঁর কাছে আজও কাপড় জামা তৈরি করতে আসেন। তিনিও এই প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়সে সেই সব জিনিস তৈরি করে দেন পুরোনো আমলের লোকদের। না হলে যে তাঁরা এই দোকানের কাটিং ছাড়া আর তাঁর তৈরি জিনিস ছাড়া পড়বেন না অন্য কোনো দোকানের জিনিস। বলে একটু হাসেন তিনি আপন মনে নিজেই।
সেই কম ভাড়ার দোকানের ভাড়া এখন প্রায় বারোশো টাকা। একসময় এই দোকানেই আরও কত কারিগর দিনরাত কাজ করত হাসিমুখে এই কথা বলতে বলতে কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর মুখ। সেলাই মেসিন এর দ্রুত আওয়াজ। রেডিওতে ভাটিয়ালী গানের সুর ভেসে বেড়াতো এই দোকানের ভিতর থেকে। কত দূর দূর থেকে তাঁর কাছে অর্ডার আসতো সেই সময়। আর সেই অর্ডার তৈরি করে সাপ্লাই দিতে ঘুম ছুটে যেত নবদার আর তার কারিগরদের। এই সেলাই এর ব্যবসা বেশ ভালো জমে গেছিলো সেই সময়। নাওয়া খাওয়া ভুলে কাজ করতে হতো এই স্কুলের নতুন বছর শুরুর সময়। মেয়ের পড়ানো, বিয়ে দেওয়া, সংসার চালানো সব তো এই সুতোয় বোনা কাজ এর দৌলতেই। একমনে পা চালিয়ে সেলাই করতে করতে নবদা বিড়বিড় করতে থাকেন। আমি চুপ করে শুনি তাঁর কথা একমনে।
সেই কুড়ি-বাইশ বছরের যুবক নবদার আজ বয়স হয়েছে বেশ। তবু সেই তাঁর দোকানে দু বেলা না বসলে চলে না একদম এটাও একটা নেশা তাঁর। কোনও রোগব্যাধি নেই একদম তাঁর। সুগার এর ওষুধ খেতে হয়না তাঁকে কোনওদিন। প্রেসার এর ওষুধ খেতে হয় না একদম। পাড়ার ডাক্তারবাবু বলেছেন কিছু হলে তাঁর কাছে যেতে তিনিই দেখে দেবেন চিন্তা করতে হবে না একদম তাঁকে কোনও। হ্যাঁ, চিন্তা আগের থেকে একটু কমেছে তাঁর। মেয়ের একটা কাজ হয়েছে আর কি। গান ভালোবাসে তাঁর মেয়ে। সংগীতভবনে পড়ার পর্ব শেষ করে এম এ পড়া শেষ করে এখন কাজ করছে সে বলেই কেমন একটু তাঁর মুখে বেমানান হাসি দেখা যায় হঠাৎ করেই।
সেই বোলপুরের স্টেশনের ওপার থেকে সাইকেল চালিয়ে তাঁর প্রতিদিন শ্রীনিকেতন রোডে এই দোকান খুলতে আসা। সেই দোকানে বসে আপন মনে সেলাই এর কাজ করা একমনে। ধীরে ধীরে তাঁর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছে আগের থেকে অনেক। সেলাই করতে করতে তিনিও মাঝে মাঝে এই বদলে যাওয়া শহরকে নিরীক্ষণ করেন ধীর দৃষ্টিতে। বেশ দ্রুত গতিতে বদলে গেলো এই ফাঁকা শহরটা এই পঞ্চাশ বছরে কেমন করে মনে মনে ভাবেন তিনি। বদলে গেলো শহরের চিত্রও। ফাঁকা শহরে এখন বড়ো বড়ো দোকান হলো কি সব বলে ওরা মল এলো। ঝাঁ চকচকে ঠাণ্ডা হাওয়া মাখা দোকানের সামনে ভীড় বাড়লো। আর তাঁর দোকানে জামা প্যান্ট তৈরি করতে আসা লোকদের সংখ্যা কমতে থাকলো ক্রমেই ধীরে ধীরে।
তবু তো তিনি এই ভেঙে পড়া দোকানকে আঁকড়েই বেঁচে আছেন আজও এই বয়সেও। যে দোকান তাঁর জীবন, যৌবন, বার্ধক্য সব, সব কিছুই। যে দোকান তাঁর প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধন সব কিছুই। যে ভাঙা পলেস্তারা খসে পড়া আর চাঙর ভেঙে পড়া এই দোকানকে ভালোবেসেই তাঁর জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেলো শুধু সেলাই করতে করতে। যে ছুঁচ সুতো আর সেলাই মেসিন এর দ্রুত আওয়াজ শুনতে শুনতেই তাঁর জীবনের এতোগুলো বছর কেটে গেলো কেমন করে তিনি টেরই পেলেন না একদম। আর এর মাঝে বদলে গেলো এই পুরোনো ছবির মত সুন্দর বোলপুর শহর, বদলে গেলো শহরের লালমাটির পথ, বদলে গেলো শহরের রাজনীতি, বদলে গেলো কতকিছুই। শুধু তিনি নিজেই নিজেকে বদলে নিতে পারলেন না এই বুড়ো বয়সেও।
সেলাই করা কারিগর নবদার গল্প - অভিজিৎ বসু।
ষোলো ফেব্রুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন