আজকের দিনটা ঘটির হার, আর বাঙালের জিত।ছোট বেলায় ঘটি আর বাঙালের তফাতটা বুঝলাম তখন। যখন আমরা শ্রীরামপুরের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে রিষড়ায় নিজেদের বাড়ী করে চলে গেলাম। রিষড়ায় সৌদামিনী নগর এলাকায় গোটা পাড়াতে একমাত্র ঘটি ছিলাম আমরাই। তাই কিছুটা যেনো একটু গুটিয়েই থাকতে হতো পাড়ায় সবার মাঝে। আর সেটা যদি ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলার দিন হতো তাহলে তো কথাই নেই।
ছোটো বেলায় স্কুল ফেরৎ এসে পাড়ায় মোড়ে দেখতাম ভীড় জটলা জমেছে বেশ। একটা ছোটো রেডিওর চারপাশে ভেনো মাছির মত কিছু মানুষ উত্তেজনায় ফুটছে আর চিৎকার শুরু করে দিয়েছে সকলে মিলে। আর সেই সময় মাঠে দৌড়ঢ্ছে সুরজিৎ সেনগুপ্ত, সুধীর কর্মকার, মহম্মদ হাবিব, কৃষানু, বিকাশ, শিবাজী দে সরকার, গৌতম ভট্টাচার্য, সুব্রত ব্যানার্জী, উলগানাথন, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য।আর বল পেয়েই মাথা নিচু করে এক দৌড়ে মাঠ পার করা সেই বিদেশ বোস, আর মানস ভট্টাচার্যরা আর ক্রম্পটনরা। মাঝে মাঝে মাটি চাপড়ে চিল চিৎকার করছে তারা। মার শালাগো আইজ মাইরাই ফ্যাল।আইজ দে কয়েক খান গোল।খুব বড়ো বড়ো কথা হালাদের আর আমাকে দেখে যেনো ওদের উত্তেজনা কিঞ্চিৎ বেড়েই যেত আরও।
এটাই ছিল আমার ছোটো বেলার ঘটি আর বাঙালের ফুটবল লড়াই এর দিনের সুখ,দুঃখের কিছু স্মৃতি। ধীরে ধীরে কেমন করে যেনো বাঙাল পাড়ায় থেকে থেকে, লড়াই করা মানুষদের খুব কাছ থেকে দেখে কেমন করে যে ঘটি হয়েও আমি ইস্টবেঙ্গল এর সমর্থক হয়ে গেলাম মনে প্রাণে কে জানে। আমার মনে হলো লাল হলুদের জন্য গলা ফাটানো বোধ হয় ন্যায় সঙ্গত।
ওদের যে জীবন যুদ্ধের কাহিনী, ওপার বাংলার লোকদের দেশ ছেড়ে এপারে চলে আসার লড়াই সংগ্রামের কাহিনী। নতুন জায়গায় এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে তারপর জীবনের লড়াই করে পরিবার, পরিজন নিয়ে লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। এগুলো দেখেই কি ছোটো বেলার কুসুম মন প্রভাবিত হয়েছিল আমার কে জানে।
কিন্তু আমি যে কোনো কারণেই হোক ধীরে ধীরে লাল হলুদকে ভালোবেসে ফেললাম। তারপর একদিন এমনি একটি দিনে সবুজ মেরুনের জয়ের দিনে বাথরুমে মুখ লুকিয়ে কাঁদলাম অনেকক্ষন। ভাত খেলাম না রাতে ঘরে। চুপ করে গুমড়ে মন মরা হয়ে কাটালাম বহুক্ষণ। আর মার বকাবকিতেও কিছুতেই আর সেই ছোট- বেলার হারের দুঃখ ভুলতে পারিনি আমি আজও। ভাত নামেনি গলা দিয়ে সেই দিন।সেই দিন থেকেই বোধ হয় পুরো পুরি আমি ঘটি হয়েও বাঙাল হয়ে গেলাম।
আসলে এই যে আজকের দিনের এই সোশ্যাল মিডিয়াতে ইস্টবেঙ্গলের জয়ে সমর্থকদের পাগলামো দেখে। আমার মনে হলো সেদিন তো আর এমন কিছু হাতিয়ার ছিল না আমাদের। তাহলে কি যে হতো কে জানে। সাকুল্যে একটা লাল হলুদ পতাকা কাঁচা বাঁশের মাথায় পত পত করে উড়ত পাড়ার মোড়ে। পুকুর পাড়ের রাস্তায় খেলার দিন গুলোতে। সেই পতাকা দেখেই বোঝা যেত যে আজ খেলা আছে। সেটাই আমাদের কাছে অনেক বড় পাওনা ছিল। আর যদি কেউ মাঠে গিয়ে খেলা দেখে আসতো সেতো ভগবান রূপে হাজির হতো আমাদের সবার কাছে।
একটু বড়ো হয়ে সেবক সংঘের মাঠে যেদিন প্রথম খেলতে যাবার ছাড়পত্র পেলাম আমি বাড়ী থেকে। সেদিন কি ভালো যে লেগেছিলো আমার সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। রোগা ল্যাকপেকে চেহারার হলেও। মনে মনে সবাই যেমন ভাবে বল পায় নিয়ে ভেলকি দেখাবে মাঠে, আমিও সেটার স্বপ্ন দেখতাম মনে মনে।
অত বড় মাঠের চারপাশে চরকি পাক দেওয়া জিভ না বের করে হাঁফ না ধরিয়ে সেটা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল সবার কাছেই। আর সেটাই প্রথম দিন করালেন নিতু দা। আজও আমার মনে আছে নিতুদার সেই কোচিংয়ের কথা। কোচ নীতুদার নাম ছিল খুব সেই সময়। কোন্নগরের সেই সেবক সংঘের মাঠ থেকে বহু খেলোয়াড় কলকাতার মাঠে খেলার ছাড়পত্র পেয়েছে বলে জানা যায়।
আর এই খেলার জন্যই যেদিন শ্রীরামপুরের বানী সংঘের ভেজা মাঠে শামুকে হাঁটুর মাংস কেটে উঠে গেল সেদিন কি বকা দিয়েছিল বাড়ির লোকজন। হাসপাতালে সেলাই করে পা নিয়ে ঘরে ফিরলাম বীর হয়ে। কিন্তু সব বীরত্ব কমে গেলো মার বকুনি খেয়ে। আর যদি মাঠে বল পিটতে দেখি কোনো দিন। কি ভয় না পেয়েছিলাম যখন সেলাই এর পা না শুকিয়ে পেকে গেলো। চিন্তায় ঘুম ছুটলো আমার। তাহলে কি সত্যিই আর বল পেটা হবে না আর কোনো দিন আমার।
সেই যে বই রেখেই দৌড়ে মাঠে নেমে বল পেটার মধ্য একটা অনাবিল আনন্দ, সুখ ছিল সেটা বন্ধ হয়ে যাবে তাহলে এই ভেবেই অস্থির হয়ে গেছিলাম আমি। শ্রীরামপুরের সেই ছোটবেলার বল পেটার সঙ্গী তরুণ, বাপি বা মৃণাল, নেরু, বাগা, ভজা, লালু, ফুচুলাল এরা সব কোথায় গেলো কে জানে। আর রিষড়ার বুড়ো, বাবুলাল, গোপাল, খোকন, ঘটু, গৌতম, মৃত্যুন, বাবুসোনা, অসিত হারিয়ে গেলো সবাই কোথায় কে জানে। স্বাধীনতা দিবসের দিন ছোটো মাঠে, ছোটো গোল পোস্টে কাদা মাঠে খেলা। আর পর দিন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে না পারায় যে কি মজা ছিল বলে বোঝানো যাবে না।
আসলে এই ভাবেই আমার ফুটবল প্রীতি জন্মে গেলো ধীরে ধীরে। খেলোয়াড় না হলেও লাল হলুদের সাপো- র্টার হয়ে গেলাম আমি মনে প্রাণে। তাই আজ এই রাতের বেলায় লাল হলুদের ফিরে আসার দিনটাকে আমার বেশ ভালো লাগলো। ফিরে গেলাম ছোটো বেলার দিনে বহু বছর পর। কৃষানু আর বিকাশ এর সেই জুটির চোখ জুড়ানো খেলা। সুরজিৎ সেনগুপ্তর সেই কর্নার কিক। বিদেশ বোস এর সেই বিখ্যাত দৌড়।আজও ভুলতে পারি না আমি। কৃশানুর সেই ছোটো পাশের খেলা আর গোল করা। আজও মনে হয় এই তো সেদিন দেখলাম এই সব।
সেই যে ছোটো বেলায় একটাকা পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে খেলা পত্রিকা কিনতাম। যার প্রথম পাতায় রঙিন ছবি থাকতো আমার প্রিয় খেলোয়াড়ের। সেই ছবিকে পাবো বলে টিফিন এর পয়সা জমিয়ে খেলা পত্রিকা কিনতাম লুকিয়ে লুকিয়ে আমি। আর দল বদলের সময় কে কাকে দলে নিল তা নিয়ে কি জোর আলোচনা, সমালোচনা চলত পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকানে , আর ক্লাব ঘরে গলা ফাটানো চিৎকার চলত। সেই আলোচনায় অংশ নিয়ে রাত করে ঘরে ফিরে মার বকুনি খেতাম। ভাত নিয়ে আর কতক্ষন বসে থাকবো আর বলে ভাতের থালা এগিয়ে দিত মা।
এটাই বোধ হয় ক্লাবকে ভালোবাসা। তার জয়ের জন্য মানত করা। এই ভালোবাসার জোরেই কোনো সময় লাল হলুদের পতাকা ওড়ে পত্ পত্ করে। আবার কোনো সময় সবুজ মেরুন নৌকা ছুটে চলে তর তর করে দুর্বার গতিতে। আজ তেমনই বোধহয় হয় লাল হলুদের দিন। ঘুরে দাঁড়ানোর দিন। লাল হলুদের ফিরে আসার দিন।
আর তাই সেই দিনে আমিও তাই একটু বেশি বক বক করলাম। মাপ করবেন আপনারা। আসলে স্নৃতির সরণীতে কৃশানুর সেই চেরা পাস, সুরজিৎ সেনগুপ্তর সেই অনবদ্য কর্ণার কিক।সুধীর কর্মকার আর সুব্রত ভট্টাচার্য্য এর সেই বিখ্যাত ডিফেন্স করা আর শিবাজীর সেই পেনাল্টি সেভ সব কিছু একসাথে হানা দিলো আজ এই গভীর রাতে।
তাই আমিও আজ আমার প্রিয় দলের জয়ে উদ্বেলিত হলাম বুড়ো বয়সে। সমর্থকদের সাথে গলা মিলিয়ে বললাম এই ভাবেই এগিয়ে চলো তোমরা। এই ভাবেই ঘুরে দাঁড়াও তোমরা। জয় লাল হলুদের জয়। জয় ইস্টবেঙ্গলের জয়। জয় আমার প্রিয় দলের জয়।
বাঙাল ঘটির ফুটবল - অভিজিৎ বসু।
পাঁচ ফেব্রুয়ারি দু হাজার পঁচিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন