সাদা জীবনের কালো কথায় আজ সিঙ্গুরের মাঠের কথা। সেই জমি আন্দোলনের কথা। যে জমি আন্দোলনের স্মৃতি সৌধের বিজয় স্তম্ভ উদ্বোধন হলো মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে দিন কয়েক আগে আরামবাগে। যে জমির জন্য অনেক লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন এর সাক্ষী গোটা রাজ্য, কিছুটা হলে আমিও।
আসলে সি পি এমের জমি দখলের রাজনীতিকে কাউন্টার করতে গিয়ে বিরোধী দল তৃণমূলও বুঝতে পারে নি যে এই বিরোধিতা তাকে অক্সিজেন সাপ্লাই করবে একদিন অদূর ভবিষ্যতে। যে অক্সিজেন নিয়ে তারা ক্ষমতা দখল করবে রাজ্যের। আসলে আন্দোলন যখন তৈরি হয়, যারা আন্দোলন করেন কিছু পাওয়ার আশায় করেন। কি সেটা হয়তো বুঝতে পারা যায় না প্রথমে। পরে ধীরে ধীরে জোরদার হয় আন্দোলন। জোরদার হয় লড়াই। তার সুফল মেলে অনেক পরে ধীরে সুস্থে।
প্রথম দিনটার শুরু তো সেই টাটার কর্তা রবিকান্ত যেদিন সাদা গাড়ি নিয়ে গ্রামে ঢুকতে গেলেন সেদিন। হাতে গোনা কজন সাংবাদিক আমরা উপস্থিত সেদিন। মাটির রাস্তায় সাদা গাড়ি ধুলো উড়িয়ে এসে দাঁড়ালো রাস্তার পাশে টাটার লোকদের গাড়ি। জমি দেখতে এসেছেন তারা। ব্যাস আরকি খবর আগুনের মত ছড়িয়ে পড়লো বাজেমেলিয়ার গ্রামে। মাটির রাস্তায় শুয়ে পড়ে সেই প্রথম দিন মহিলারা বুঝিয়ে দিলেন বিনা যুদ্ধে নাহি দিবো সুচগ্র মেদিনী। সত্যিই তো কেনই বা বাপ ঠাকুর্দার জমি একলপ্তে অন্যর হাতে তুলে দেবেন তারা। একই মগের মুলুক নাকি। যতই পার্টি বলুক আর সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা নেতারা গ্রামে ঘুরে বলুক জমি দিয়ে দাও তোমরা কারখানা হবে গো।
কেমন একটা যেনো চিনচিনে ব্যাথা বুকের মাঝে জেগে ওঠে সিঙ্গুরের গ্রামের মানুষদের মধ্যে। বুকের গভীরে চেপে বসে জেদ, তৈরি হয়ে যায় ইচ্ছুক আর অনিচ্ছুক দুটি দলের দুটি ভাগ। একদল বলে জমি দিয়ে কারখানা করা হোক। অন্য দল বলে না জমি নেওয়া যাবে না কোনো ভাবেই। সত্যিই তো এই দু পক্ষের দড়ি টানাটানি আর লড়াই এর মাঝে শুরু হয় রাজনৈতিক তরজা জোর কদমে। সিঙ্গুর বিডিও অফিসে চেক বিলির সেই রাতের কথা। প্রতিদিনের দৌড় আর দৌড়। হিসেব করে দৌড় নয়, খবরের জন্য বেহিসেবী দৌড় আমার। সত্যিই তো আমার এই বাতিল জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভাবি সেই দৌড়ের কথা। যে দৌড়ে সামিল হয়েও রাজনীতির কুশীলবদের হাতের ক্রীড়নক হতে হয় নি আমায় কোনো দিন।
কত কথা আজ মনে পড়ে যায়। সিঙ্গুরের দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের রাস্তার পাশে ক্যাম্প করে জমি পাহারা দেওয়া মুকুল রায় এর কথা। রাতের অন্ধকারে গ্রাম এর মাঝে জমি পাহারা দিয়ে রাত জাগা সুব্রতদার মজার অভিজ্ঞতার কথা। আর সেই যে মাঠে নেমে পুলিশের এলোপাথাড়ি লাঠির বাড়ি খেয়েও দাঁতে দাঁত চেপে যে লড়াই করার সাহস দেখালো সিঙ্গুরের গ্রামের মানুষরা সেদিন তো আন্দোলনের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্ধেক অক্সিজেন পেয়ে গেলেন তিনি শাসকদল কে হারিয়ে হাসি মুখে। তাপসী মালিক, রাজকুমার ভুলের মৃত্যু আন্দোলনকে আরো জোরদার করলো। আরো বেশি করে অক্সিজেন দিলো।
যে আন্দোলনের স্মৃতি সৌধ বিজয় স্তম্ভ তৈরি হলো তার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হলো জমি। পুলিশের নজর এড়িয়ে পৌঁছনো যাবে না গ্রামে। আন্দোলনকে ভেঙে দিতে হবে যে করে হোক। কিন্তু মেধা পাটেকর গ্রামে পৌঁছে গেলেন আমাদের সাহায্য নিয়ে অনায়াসেই। চাষীদের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন জমি দখল করতে দেওয়া যাবে না কোনো ভাবেই। গ্রেফতার হলেন পুলিশের হাতে মেধা পাটেকর। আন্দোলনের ঝাঁজ বাড়ছে। ধীরে ধীরে লোক বাড়ছে সিঙ্গুরে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে লোক ভরে উঠলো। তারা সবাই সিঙ্গুরে আসতে শুরু করলো। জমজমাট হয়ে গেল সিঙ্গুরের রাস্তাঘাট।
শাসক দল ততো দিনে বুঝে গেলো হাওয়া খারাপ। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আর সমঝোতার সূত্র বের করতে হবে না হলে কারখানা করা যাবে না কিছুতেই। আলোচনা হলো রাজভবনে আশায় বুক বাঁধলো অনেকে কারখানার আশায় জমিদাতারা। কিন্তু না, হলো না কারখানা। আইনের বেড়া টপকে সিঙ্গুরের জমি দখল করতে পারলো না টাটারা। চলে গেলো তারা সিঙ্গুর ছেড়ে। জয় হলো আন্দোলনের। সেই জয় এর স্মৃতি স্তম্ভ, সৌধ নির্মাণ করা হলো এত দিন পরে স্বগর্বে, ঢাকঢোল পিটিয়ে।
আসলে সাদা জীবনের কালো কথায় সেই সব দিন গুলোর কথা মনে পড়ে গেলো। মনে হলো এসব কথা লিখে রাখা দরকার। যে আন্দোলনের স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হলো। সেই সিঙ্গুরের গ্রামের মানুষদের জন্য সত্যিই কি ভালো হলো কারখানা না হয়ে। কৃষি আর শিল্পের সংঘাতে কি সত্যিই লাভ হলো সিঙ্গুরের সাধারণ মানুষের। নাকি লড়াই করতে গিয়ে কৃষি জমি জিতে গেলো শিল্পকে গো হারা হারিয়ে দিয়ে।
নাকি শুধু মাত্রই একটা মামুলি আন্দোলন, জোর করে জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে সবাইকে আহ্বান জানিয়ে আন্দোলন করা হলো সিঙ্গুরের মাটিতে। যে আন্দোলনের সুফল পেলো আন্দোলন করা একটি রাজনৈতিক দল। আর আজ এত দিন পর সেই আন্দোলনের স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করে স্যালুট জানালো তারা তাই। সেই দিনের চুপসে পড়া রাজনীতির ময়দানে ঘোর বিপাকে পড়া দলটি।
রাজনীতির ঘোর প্যাঁচ না বুঝে এটা বলা যায় যে জমি রক্ষা আন্দোলন কারীদের লড়াইকে কুর্নিশ জানাই। যারা সেদিন দা, কাস্তে, হাতা, খুন্তি, নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিল। শুধু নিজেদের বাপ ঠাকুর্দার ভিটে মাটি কে রক্ষা করতে। না হলে হয়তো আজকে তাদের গ্রামে এই বিজয় স্তম্ভ তৈরি হতো না।
ফিরে এলো তাপসী মালিক - অভিজিৎ বসু।
পনেরো ফেব্রুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক ও গুগল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন