শৈলজারঞ্জন মজুমদার এর ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো শান্তিনিকেতনের লিপিকা প্রেক্ষাগৃহে। যিনি একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রশিক্ষক, রবীন্দ্র সঙ্গীতের স্বরলিপিকার ছিলেন। যদিও তিনি বিশ্বভারতীর রসায়ন বিভাগের শিক্ষক। তাঁর জন্ম হয় ১৯০০ সালের ১৯ শে জুলাই ময়মন সিংহের নেত্রকোনা এলাকায়। ছোটো থেকেই তাঁর গানের নেশা। তিনি আট নয় বছর বয়সে তাঁর পাঠশালায় পড়ার সময় ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি শৈলজারঞ্জনের বিশেষ আগ্রহ ছিল । আট-নয় বছর বয়সে পাঠশালায় পড়ার সময়, তিনি তার ঠাকুরমার (প্রখ্যাত লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর পিসিমা) কাছে গান শেখেন এবং তার কাছ থেকে প্রথম রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গানের কথা শুনেছেন। এমনকি তিনি স্থানীয় শিল্পীদের কীর্তন, শ্যামাসংগীত, বাউল, ভাটিয়ালী, প্রভৃতি লোকসঙ্গীত শুনে শুনে কিছু কিছু গান আয়ত্ত করেন।
বিদ্যাসাগর কলেজে আই.এসসি পড়ার সময়ে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের "পাগলাঝোরা" নামের এক অনুষ্ঠানে গানের দলে নাম লেখান। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথের নিজ কণ্ঠে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ গান এবং ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে’ কবিতার আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হন – রবীন্দ্র অনুরাগী হয়ে পড়েন। শান্তিনিকেতনের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রভাতচন্দ্র গুপ্তর উদ্যোগে তিনি ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে শান্তিনিকেতনে রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপকরূপে যোগ দেন। এর সুবাদে কবিগুরুর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শেখার পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি করা শুরু করেন। ধ্রুপদী সংগীতে তালিম নেন হেমেন্দ্রলাল রায়ের কাছে। ক্রমে রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়ে উঠলেন শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। সেই থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন সঙ্গীত ভবনের একটা স্তম্ভ যাঁর উপর নির্ভর করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সেই শৈলজারঞ্জন মজুমদার এর ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো দুদিন ধরে শান্তিনিকেতনে। হাজির ছিলেন বহু বিশিষ্ট মানুষ। সঙ্গীত ভবনের ছাত্র ছাত্রীরা নৃত্য পরিবেশন করে। তাঁর পরিবারের এক সদস্য শুভায়ু সেন মজুমদার এসরাজ বাজান। আর এই অনুষ্ঠানে তাঁকে নিয়ে দুটি বই প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সুশান্ত দত্ত গুপ্ত
প্রাক্তন উপাচার্য, বিশ্বভারতী। যিনি তাঁর ভাষণে বলেন, যতদিন যাচ্ছে এইসব মানুষের জন্মদিন পালনের লোক কমে যাচ্ছে। তবুও এই অনুষ্ঠানে তিনি আসতে পেরেছেন তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সেটা তাঁর খুব ভালো লেগেছে এমন একজন মানুষের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তিনি হাজির হতে পেরেছেন। ফাগুনের নবীন আনন্দে...
রবীন্দ্রসংগীতের প্রবাদপুরুষ ব্যক্তিত্ব আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার'র ১২৫-তম জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের দ্বিতীয় দিবসে সংগীত-ভবনের নিবেদন 'নৃত্যচঞ্চল মঞ্জীরধ্বনি' । নৃত্যপরিচালনায় : অধ্যাপক শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়। নাচে আর গানে মেতে ওঠে বিশ্বভারতীর সংগীতভবনের ছাত্র ছাত্রীরা। যিনি গুরুদেবের অতি প্রিয় ছিলেন।
এই প্রেক্ষাগৃহের বাইরে অনেক দুষ্প্রাপ্য কিছু ছবির প্রদর্শন করা হয়। যে ছবিতে ফুটে উঠেছে তাঁর জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাজীব গান্ধীর হাত থেকে তাঁর দেশিকত্তম পুরস্কার নেওয়া। গুরুদেবের সাথে তাঁর নানা ছবি। জওহরলাল নেহরু আশ্রমে এসেছেন সেই ছবি। গুরুদেবের দেওয়া সেই টেবিল আর এসরাজ নিয়ে বসে আছেন তিনি। যে সাদা কালো ছবির গুরুত্ব আলাদা। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষপদে ইস্তফা দিয়ে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসেন । এখানে তাঁর প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র ছিল "সুরঙ্গমা"। তাঁরই পরিকল্পনায় ও সক্রিয় তত্ত্বাবধানে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর আগে 'গীতবিতান' ও 'দক্ষিণী' প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর অনেক খানি অবদান ছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথের বহু গানের স্বরলিপি রচনা স্বরবিতানের সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজ করতে থাকেন। প্রায় দেড়-শোটি গানের সুরকার তিনি।
রবীন্দ্রনাথের প্রধানত শেষ যুগের গানগুলির তিনিই প্রধান স্বরলিপিকার। কয়েক খণ্ড স্বরবিতানের সম্পাদনাও করেছেন। তাঁর সঙ্গীতচর্চায় তানপুরা ও এস্রাজ- এ দুটি অনুষঙ্গ যন্ত্রই ব্যবহৃত হয়েছে । তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত রবীন্দ্র সংগীতে হারমোনিয়ামের বিরুদ্ধতা করে গেছেন । রবীন্দ্রসংগীতের সংরক্ষণ ও তার শুদ্ধতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য । তিনি তার সুদীর্ঘ জীবনে বহু ছাত্রছাত্রীকেও রবীন্দ্র-সঙ্গীতের শিক্ষাও দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন – কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন,অরুন্ধতী দেবী, শুভ গুহঠাকুরতা প্রমুখ ।
শৈলজারঞ্জনের কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উপাস্য দেবতার মতো, আর 'গীতবিতান' ছিল তাঁর কাছে 'বেদ' বা 'গীতার মতোই পবিত্র গ্রন্থ' । ও দিকে রবীন্দ্রনাথও তাঁকে ভালবাসতেন নিবিড় মমতায়। গুরুদেবের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুব কাছের। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে শৈলজারঞ্জনই প্রথম নেত্রকোণায় রবীন্দ্র জয়ন্তী উদ্যাপন করেন এবং তার উদ্যোগে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় । সুতরাং, বলাচলে দুই বাংলায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের অনুষ্ঠান-শুরু এই রবীন্দ্র অনুরাগীর উদ্যোগেই ।১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে সংগীত আকাদেমি পুরস্কার দেন এবং ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশ্বভারতী থেকে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মাননা পান। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট প্রদান করে । এই মানুষটির ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো শান্তিনিকেতনে। সবাই স্মরণ করলেন তাঁদের খুব কাছের শৈলজাদাকে।
সাদা কালো ছবিতে ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনের শৈলজারঞ্জন - অভিজিৎ বসু।
২৬ মার্চ, দু হাজার পঁচিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন