ফাঁকা সবুজ মাঠে বসানো আছে যন্ত্র। মাথার ওপর নীল উন্মুক্ত বসন্তের আকাশ। দূরে নাম না জানা পাখির উড়ে যাওয়া মাঠ পেরিয়ে তেপান্তরের পারে সেই অচিন দেশে। আর ঘর, বাড়ী, আত্মীয়, স্বজন, পরিজন, বন্ধু রাতের বেলায় মনের কথা বলা মোবাইলের বান্ধবী, সেই আমার জীবনের চির শত্রুকে ছেড়ে, সমাজ সংসারকে ভালবেসে তাদের ছেড়ে চলে যাওয়া দুরে অনেক দূরে। হ্যাঁ,জীবনকে ছেড়ে চলে যাওয়া, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেওয়া। বুকে জড়িয়ে হাসতে হাসতে কেমন অক্লেশে, নির্ভয়ে, নিরাপদে। জ্বালা যন্ত্রণাহীন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা হাসিমুখে।
সেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেবার একটা যন্ত্রও আবিষ্কার হয়ে গেলো যে। মাত্র এক মিনিটে গোটা একটা জীবনের, সেই হাসি কান্নার যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর যন্ত্রও যে কেমন করে আবিষ্কার হয়ে গেলো এই ধূলিধুসর পৃথিবীতে কে জানে। তাহলে আর চিন্তা কি। আমার মেয়ের কথায় এতো মরার ক্যাপসুল গো। সত্যিই অম্বল ,বদহজম, মাথাধরা, মাথা ঘোরা, বমি বন্ধের ক্যাপুসল এর কথা শুনে অভ্যস্ত। এ যে একেবারে একদম মরার ক্যাপসুল। যে যন্ত্র এই বছর ব্যবহার করতে চলেছে সুইজারল্যান্ড।
একদম সীতার পাতাল প্রবেশের মতো যন্ত্রে প্রবেশ করলেই ল্যাঠা চুকে গেল। একদম বেদনাহীন আনন্দের মৃত্যু। মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই মৃত্যু। একদম যন্ত্রণাহীন মৃত্যু। শুধু বুকে বল নিয়ে একটু নিজের সম্মতিতে একবার মেশিনে শুয়ে পড়লেই হলো। ব্যাস আর কি মুক্তি। জীবন থেকে একেবারেই মুক্তি। হাজার ঝক্কি ঝামেলা থেকে মুক্তি। ব্যাংকের ই এম আই থেকে মুক্তি, বউয়ের সন্দেহ থেকে মুক্তি, অফিসে বসের গাল খাওয়া থেকে মুক্তি। পাড়ায় কম বেতনে কাজ করার জন্য দূর্গা পুজোয় কম চাঁদা দিয়ে পাড়ার ছেলেদের কাছে হাসির খোরাক হওয়া থেকে মুক্তি।
বাজারে গিয়ে হাসিমুখে জিনিস কিনে বিক্রেতার কাছে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া থেকে মুক্তি। মেয়ের কাছে বড়ো অর্থবান বাবা হতে না পারার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। পাড়ার কালিদার প্রতি সন্ধ্যায় ক্লাবে তাসের আড্ডায় জ্ঞান শোনা থেকে মুক্তি। সত্যিই জীবনের এই মায়া আর মোহ কাটিয়ে একবার এই যন্ত্রে চেপে পড়লেই হলো। তাহলেই একদম কেল্লাফতে। মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করে অজানা অচেনা দেশে পাড়ি দেওয়া ঠিক যেনো সেই সুনীতা উইলিয়ামস এর মত। কিন্তু বুকে বল নিয়ে যন্ত্রের দরজা খুলেই কেমন যেনো দুর থেকে সবুজ মাঠের ধার থেকে ভেসে আসে সেই কবির বিখ্যাত লাইন।
মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,
মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন 'পরে
বাঁধা সবার কাছে
রাখো রে ধ্যান, থাক্ রে ফুলের ডালি,
ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি,
কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে
ঘর্ম পড়ুক ঝরে।
সত্যিই তাহলে মুক্তি নেই। যে মুক্তির জন্য এত
আয়োজন। যে মুক্তির জন্য ভারতীয় মুদ্রায় বেশি নয় মাত্র অল্প কিছু টাকা খরচ করলেই হলো। যে মুক্তির জন্য মাত্র এত চিন্তা। সেই বেদনাহীন আত্মহত্যার যন্ত্র নিয়েই এখন জোর আলোচনা। সত্যিই অসাধারণ এই আত্মহত্যার যন্ত্র। এগ্জিট ইন্টারন্যাশনালের তৈরি গোলাকার কফিন আকৃতির যন্ত্রটির নাম ‘সারকো পড ক্যাপসুল’।
এই যন্ত্রটিতে কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। কফিনে ঢুকে আত্মহত্যায় ইচ্ছুক ব্যক্তি একটি বোতাম টিপলেই নাইট্রোজেনে ভরে যাবে ক্যাপসুলটির অন্দর। এতে প্রথমে অক্সিজেন কমে আসায় অস্বস্তি বোধ করলেও ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাবেন ওই ব্যক্তি। তবে কোনও আতঙ্ক বা দমবন্ধকর পরিস্থিতি গ্রাস করবে না তাঁকে। প্রাথমিক ভাবে সারকো পড ব্যবহারের জন্য ন্যূনতম বয়ঃসীমা ৫০ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর কম বয়সে এই যন্ত্র বাবহার করা যাবে না।
শুনতে অবাক লাগলেও সুইৎজ়ারল্যান্ডে আত্মহত্যার অধিকার রয়েছে নাগরিকদের। পরিসংখ্যান বলছে, সুইৎজ়ারল্যান্ডে আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়শই ঘটে। সেখানে আত্মহত্যায় সহায়তা করাও আইনত বৈধ।
যদিও ভারতে স্বেচ্ছামৃত্যু, আত্মহত্যায় সহায়তা কিংবা ইউথেনেশিয়ার মতো বিষয়গুলি এখনও আইনত অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।
যদি কোনোদিন সেই যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর যন্ত্র এই আমাদের দেশে অনুমোদন পায়। তাহলে কি যে হবে কে জানে। সবুজ মাঠের ধারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ট্যাপার কর্মহীন বাবা। আর ট্যাপার মা লোকের বাড়ী কাজ সেরে দৌড়তে দৌড়তে কান্না ভেজা গলায় বলছে মিনসে আমায় জ্বালিয়ে মারলো গো। লাইনে নাম ধরে ডাকছে ট্যাপার বাবার। জীবন কে ছেড়ে চলে যাবার ডাক। অনেক কষ্টে এই কটা টাকা সে জোগাড় করেছে সে নেশা না করে সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে।
কিন্তু কোথায় সেই মুক্তি। যে কালো মেয়ের হাত ধরে ভাঙা ঘরে সংসার পেতেছিল দুজন মিলে একদিন। একজন যে কিছুতেই তাকে ছাড়তে চায় না কিছুতেই এইভাবে। জীবন যে বড্ড মায়ার। জীবন যে বড্ড ভালোবাসার। জীবন যে বড্ড আদরের। তাই নিশ্চিত যন্ত্রণাহীন মৃত্যু নয়। তার চেয়ে এই যন্ত্রণার জীবন বোধহয় অনেক ভালো। যে জীবনে জড়িয়ে আছে ট্যাপার মায়ের ভালোবাসার উত্তাপ।
নিশ্চিত যন্ত্রণাহীন মৃত্যু নাকি ভালোবাসার উত্তাপ - অভিজিৎ বসু
সাতাশ মার্চ, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য গুগল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন