সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তিন নারী

নারী দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠান সব শেষ। জীবনের শুরু থেকে শেষ প্রান্তে এসে এই তিনজনকে বাদ দিয়ে আর কার কথাই বা বলবো আমি। পুরুষের জীবনের প্রথম পর্বে মা নিজে এমন একটা জায়গা আগলে নিয়ে থাকেন তাঁকে বাদ দিয়ে জীবনের স্বাদ কেমন আলুনি লাগে। গড়পড়তা আম বাঙালির অবস্থা একই প্রায়। আসলে মায়েদের আমলে এই ভাবে তো আর দিবস পালনের কোনো হৈ হুল্লোর হুড়োহুড়ি ছিল না। 


তাই মার কাছে নারী দিবস পালন করে গলা উঁচিয়ে বলা নয় যে তুমিই সব। গোটা পরিবারের, গোটা সংসারের সব এক ছত্র মালিক তুমি মা। আসলে বোধ হয় এমন বলে আমরা মানে আমি, বাবা, পরিবারের অন্যরা সবাই মই তে তুলে দিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছি কি ভাবে দু হাতের মুঠোয় কি করে সব অনায়াসে সামলে নেয় হাসি মুখে মায়েরা। কোনো দিন অভাব অভিযোগ নেই। শুধু মুখ বুজে সব সহ্য করে বেঁচে থেকে সামলে নিয়ে চলা। সেখানে উনুনের ধোঁয়ায় চোখের জলে সংসার সামলে মনে থাকে না কিসের দিবস পালন। আর কার দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে সে সব কিছুই গায়ে লাগে না মার। জীবনের অনেক অংশ জুড়েই তো মা, মা আর শুধুই মা। যে আজ আমার জীবনের সবচেয়ে প্রথম আলো দেখানো মা সেই তো আজ নেই। যে আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে ভালবাসার উত্তাপ। যে উত্তাপে আমি আজও শীতের রোদ খুঁজে বেড়াই। 

মার পরে যার কথা না বললেই নয় সে সোমা। আসলে মার অভাব পূরণ হবার নয় কোনো দিন। কিন্তু আমার মত এই পাগল লোকটাকে মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে যে নারী আমাকে নিয়ে জীবনের এত গুলো বছর কাটিয়ে দিল তার কথা না বললে অপরাধ হবে আমার। সেই অপরাধের যে কোনো ক্ষমা নেই। তাই মার স্থান শুন্য হবার পর ওর জন্য তো আমি আজও বেঁচে আছি পৃথিবীতে। কোনো ভাবে সমাজে সংসারে সব জায়গায় টিকে আছি আজও। 

ওর লড়াই, ওর মুখ বুজে কাজ করে যাওয়া সব কিছুই যেনো পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় আমায়। মনে হয় আমি সত্যিই এই দুজনের সাথেই বড়ো খারাপ ব্যবহার করেছি। তাই নারী দিবসের আলোচনা নয় কোনো স্মৃতি চারন নয় শুধু এটা বলবো যে এই দুজন না হলে, না থাকলে আমি আজ আপনাদের কাছে এসব কথা বলতে লিখতে পারতাম না বোধ হয়। কোথায় হারিয়ে যেতাম কে জানে। তাই সোমার সংসার বাঁচানোর লড়াইকে কুর্নিশ জানাই আবার। বলি যে তোমরা মেয়েরা বোধ হয় পারো এমন করে হাল ধরতে। দিক হীন নৌকার হাল ধরে তাকে এগিয়ে নিয়ে চলো। আর আমাদের মত বে আক্কেলে লোকরা নিশ্চিন্তে নিরাপদে তোমাদের হাতে হাল তুলে দিয়ে কেমন মজা করে জীবন কাটায় সুখে দিবা নিদ্রা দিয়ে।

কিন্তু সুখে দিবা নিদ্রায় যিনি আমায় ঘুমোতে দেন না কোনো ভাবেই। শুধুই যাকে ভয় পেয়ে, ভক্তি করে মুখ বুজে চলতে হয় আমায় সেই বুটাকে আমি এই বুড়ো বয়সেও ভয় পাই, আকন্ঠ ভালোবাসি ওকে। জীবনের শেষ পর্বে এসে মনে হয় মেয়েকে এই জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা হলো জীবনের আসল প্রাপ্তি। যাকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক গভীর গোপন এক ভালোবাসার অনুভূতি। বাবা মেয়ের এই গভীর গোপন ভালোবাসা আজীবন টিকে থাকে। 

ছোটো মেয়ে থেকে ওর বড়ো হয়ে ওঠা। ওর জন্য বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা কান্না হাসি নিয়েই তো আমার আজকের জীবন। যে জীবনে কষ্ট থাকলেও এক বুক আশা আছে। এক বুক অভিমান আছে। এক টুকরো চাঁদের নরম আলো আছে। যা গায়ে মেখে আমি আর মেয়ে সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াই এদিক ওদিক। ও বলে এত জোরে নয় আস্তে চালাও বু। আমায় চোখ পাকিয়ে ও সাবধান করে। আমিও কেমন ওর কথা শুনে বুড়ো বয়সে চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শুনি ওর কথা। 

যার জন্য আজ কষ্ট হয় যে ওকে নিশ্চিন্তে নিরাপদে জীবন যাপন থেকে কেমন করে যেনো কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিয়েছি আমি নিজেই। তার জন্যে আজ বড়ো কষ্ট হয় আমার। অনুশোচনা হয় বড়ো। মনে হয় এমন ভুল না করলেই বোধহয় ভালো হতো। যখন ও বলে তুমি বোধ হয় আর কাজ পাবে না কোনো দিন। তোমায় কি আর কেউ কাজ দেবে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি চুপ করে শুনি আমি। ওর আমার দুজনের চোখের কোন ভিজে যায়। তারপর ও আমায় কেমন যত্ন করে সব ভুলে কাছে টেনে নিয়ে আমার চোখের জল মুছে দেয়। আমি কেমন বিবশ হয়ে যাই। সেই ছোটো বেলার মত যে ভাবে মার কাছে কোল ঘেঁষে থাকতাম তেমন করে ওকে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকি।

 আর ভাবি এটাই বোধ হয় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার বড়ো পাওনা হলো। যাকে ভাষা দিয়ে লিখে বোঝাতে পারবো না আমি। শুধু এটা বলতে পারি এই পাওনা নিয়ে আজ আমি সব হারিয়েও বেঁচে আছি। আমার বুটার মুখের দিকে তাকিয়ে। ওর ছোটো মেয়ে থেকে নারী হয়ে ওঠার এই ছোটো ছোটো ভালোবাসার টুকরো টুকরো আনন্দকে বুকে আগলে চেপে বেঁচে আছি আজও। 

জীবনের বাকি কটা দিন যেনো এভাবেই কেটে যায় আমার। আমার ছোট্ট বুটার নারী হয়ে ওঠা দেখতে দেখতে। যার কাছে এক বুক কষ্ট নিয়ে গেলে অনায়াসে কাছে টেনে নিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে ও আমায় বলে তুমি ভেবো না আমি আছি তো। আমি হাউ হাউ করে ওকে জড়িয়ে ধরি। আর আমার সেই হারিয়ে যাওয়া মার উত্তাপ অনুভব করি। ও ধীরে ধীরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমি চোখ বুজে চুপ করে ওর কোলে শুয়ে থাকি।

তিন নারী - অভিজিৎ বসু। 
আট মার্চ, দু হাজার চব্বিশ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

জামালপুরের প্রদীপ দা

আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় বর্ধমানের জামালপুরের সেই দাপুটে ঠোঁট কাটা সাংবাদিক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এর কথা। সেই বিখ্যাত সুভাষ তালুকদার এর কাগজ সংবাদে মাত্র এক টাকার কাগজে কাজ করা সংবাদ পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক সেই প্রদীপ দা। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বাঁশের ব্যারিকেডের এপারে দূরে দাঁড়িয়েও যে খবর করা যায় সেটা বড়ো মিডিয়ার সাংবাদিকদের হাসি মুখে দেখিয়ে দিয়ে, আর তাদের খবরের ময়দানে গোল দিয়ে শুধু খবরকে ভালোবেসে ছোটো কাগজে কাজ করে চলা সর্বদা হাসি মুখের সেই আমাদের প্রদীপ চ্যাটার্জী দা।  কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে যাওয়া আর এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়া ঝোলা কাঁধে সেই খবরের খোঁজে সেই জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রদীপ দা। সেই বিখ্যাত পন্ডিত রবিশঙ্কর আর উদয়শঙ্কর এর আপন মাসতুত ভাই এর ছেলে সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় দাদা। সেই বামদের আমলে জামালপুরের এলাকায় দাপিয়ে খবর করে ছুটে বেড়ানো সেই প্রদীপ দা। সেই তৃণমূল আমলেও একভাবেই ছুটে বেরিয়ে কাজ করা আমাদের সদা ব্যস্ত প্রদীপ দা।  সেই বাবার অসুস্থতার কারনে বড়ো সংবাদ মাধ্যমে কাজ না করেও...

আমার স্যার কাজীদা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।  কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।  কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ স...

কুড়ি থালা দশ টাকা আর রসিক মুলুর জীবন

নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।  ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।  একে অপ...

শুভ মকর সংক্রান্তি

মকর মানেই নতুন জামা কাক ভোরে স্নান, রাত্রি জেগে মিঠে সুরে টুসুমণির গান। মকর মানেই পিঠে - পুলির গন্ধে ম - ম হাওয়া, ডুলুং পাড়ে টুসুর মেলায় দল বেঁধে যাওয়া। মকর মানেই মোরগ লড়াই পাহুড় জেতার সুখ, সন্ধ্যা - রাতে মাংস পিঠের স্বাদে ভরা মুখ। মকর মানেই হাতি - ঘোড়ার পুজো করম তলে, সান্ধ্য হাওয়ায় মন উদাসী দিমির দিমির বোলে। আসলে আজ এই মকর সংক্রান্তির দিন, টুসু মেলার দিন, টুসু গানে নিজেকে মাতিয়ে দেবার দিন। অজয় এর ধারে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় ভীড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেবার দিন। অজয় এর জলে ডুব দিয়ে স্নান করে পূণ্য অর্জনের দিন। আর নদীর ধারে মোরগ লড়াই এর দিন। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, সুতো লাটাই হাতে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার দিন। কেমন যেনো রাশির একটি স্থান থেকে অন্য রাশিতে স্থান পরিবর্তনের দিন। সূর্যের দেবতাকে সকালে উঠে স্নান সেরে প্রণাম জানিয়ে শক্তি সঞ্চয় এর দিন। সূর্যের উত্তর দিকে চলে যাবার দিন। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাওয়ার দিন।  এই মকর সংক্রান্তি এর ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড় রয়েছে। এটি কৃষি চক্র এবং ফসল কাটার মৌসুমের সাথে জড়িত। এই মকর সংক্রান্তি চ...