সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সিংহ বাহিনী মা

আসলে বলতে কি গ্রাম বাংলায় এমন মন্দির যে কত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবু বীরভূমের এই অমরপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এর ইকড়া গ্রামের সিংহবাহিনী মন্দিরের কথা লেখার ইচ্ছা হলো আজ আমার। তার কারণ একটা আছে কেনো লিখলাম এই মন্দিরের কথা। লেখাটা পড়লেই বুঝতে পারবেন আপনারা।

আসলে বলতে কি কদিন আগেই এই গ্রাম পরিদর্শনে গেছিলাম আমি। কি কারণ সেটা হয়তো আর বললাম না। কিন্তু এই শান্ত সুনিবিড় গ্রাম দেখে বেশ ভালই লাগে আমার আজকাল। শহুরে জীবনের হাঁস ফাঁস দম বন্ধ অবস্থা থেকে একটু মুক্তি পাবো এই আশায় গ্রামে ঘোরা।

আসলে বলতে কি শহুরে মানুষের জীবনে চলতে চলতে এমন ফাঁকা মাঠ, মনোরম সবুজ সুন্দর জায়গা দেখলেই কেমন যেনো আদিখ্যেতা জেগে ওঠে এই শহুরে মানুষের মনের মধ্যে। মনে হয় আমার তাহলে যদি এমন একটা গ্রামে জীবনের শেষ কটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। কেমন হয় মন্দ হয়না কি বলেন সবাই আপনারা। কিন্তু সাধ হলেও সাধ্য নেই আমার। তাই সাধের পূরণ হবে কি করে বলুন। তবু মনের সাধটা রয়েই যায় গোপনে মনের মাঝে।

 যাই হোক ধান ভানতে শিবের গীত না গাওয়াই ভালো কি বলেন আপনারা। শহুরে মানুষের জীবনে গ্রাম্য প্রেম আদি অকৃত্তিম অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে এটা একদম নিখাদ গ্রাম্য প্রেম। যে প্রেমে পড়ে আমি বহুদিন ধরেই গ্রামের মেঠো রাস্তায়, ধানের শীষে সবুজ ঢেউ দেখে, আলু ক্ষেত দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে মাঠে দৌড়ে যাই। যা শহুরে ছেলেমেয়েরা অনেকেই এটাকে একটু বাড়াবাড়ি মনে করেন। আসলে এটা সেটা নয়।

যাই হোক এই ইকড়া গ্রামের মাঝে বহু বছর ধরে একটি মন্দির আছে সিংহ বাহিনীর মন্দির। গ্রামের চ্যাটার্জি পরিবারের শ্রীকান্ত চ্যাটার্জীর কথায় আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে হবে মধ্য রাতে ঝড় বৃষ্টির মাঝে এক মহিলা এই সিংহ বাহিনীর মূর্তি এনে রেখে যান এই ইকড়া গ্রামের চ্যাটার্জি পাড়ায়। তারপর থেকে মা সিংহবাহিনীর পূজো করে আসছেন চ্যাটার্জী পরিবারের সদস্যরা বংশ পরম্পরায়। মা সিংহ বাহিনী, মহিষাসুর মর্দিনী আর গণেশ এর পূজো করে আসছেন তারা। 

আসলে এটা অনস্বীকার্য যে মা সিংহ বাহিনী এই গ্রামের মাঝে একদম বিপদে আপদে সবার সাথে জড়িয়ে গেছেন তিনি। তাই সেই পুরোনো ভগ্নপ্রায় মন্দির, তার টিনের দরজা বন্ধ রেখেই তো মায়ের নিত্য পূজা অর্চনা হয়ে আসছে এত দিন ধরে। কোনো দিন কিছুই হয়নি। এই গ্রামের একটু দুর থেকে বয়ে গেছে বক্রেশ্বর নদী। আগে গ্রামের কোনো বাড়িতে অনুষ্ঠান হলেই সে বিয়ে হোক, জন্মদিন বা অন্নপ্রাশন সব অনুষ্ঠানে এই মন্দিরে এসে মাকে প্রনাম করে তবে শুভ কাজ শুরু হয়। এটাই গ্রামের রীতি।

 এই ভাবেই বছর বছর ধরে মা পূজিতা হয়ে আসছেন মন্দিরে। প্রায় দুশো বছর আগের মন্দির ভগ্নপ্রায় হলে তাকেও সংস্কার করে নতুন করা হয়। প্রতিদিন ফুল জল দিয়ে মার পূজা করেন চ্যাটার্জী পরিবারের সদস্যরা। বেশ ভালই চলছিল এই ভাবেই। কিন্তু গোল বাধল দু হাজার তেইশ সালের চৌঠা সেপ্টেম্বর রাতে অর্থাৎ পাঁচ তারিখ ভোরবেলায় দেখা যায় মন্দিরে মা সিংহ বাহিনীর মুর্তি সহ তিনটি মূর্তি উধাও। কোথায় গেলো, কারা নিয়ে গেলো, কোনো কিছু জানা গেলো না। 

গোটা গ্রামে রটে গেলো সেই খবর মন্দির থেকে মা বেপাত্তা হয়ে গেছেন। যা কোনো দিন হয়নি তেমন ঘটনা ঘটে গেলো এই শান্তির গ্রামে। মন ভালো নেই চ্যাটার্জী পরিবারের সদস্যদের। মন ভালো নেই গ্রামের মানুষেরও। নতুন মন্দির স্থাপন করা হলো এই চ্যাটার্জী পাড়ায়। মাকে বসানো হলো কিন্তু তিনি উধাও হয়ে গেলেন কি করে। কোথায় গেলেন মা সহ তিন তিনটি মুর্তি। 

দেখতে দেখতে বেশ কয়েক মাস কেটে যায়। কোনো খবর মেলে না। আট মাস হয়ে গেছে মার মূর্তির কোনো সন্ধান নেই আর। মন খারাপ সকলের। যে মা একদিন ঝড় জলের রাতে নিজেই সবার অজান্তে এসেছিলেন এই গ্রামে। সেই মা চলে গেলেন এই কষ্ট কুড়ে কুড়ে খায় চ্যাটার্জী পরিবারে সদস্যদের। বোধহয় মা শুনতে পান সন্তানের কষ্টের কথা। সত্যিই অসাধারন ঘটনা ঘটে গেলো দিন কয়েক আগেই।

 আর তাই দিন কয়েক আগেই এপ্রিল মাসের দু তারিখ ভোর বেলায় মার মূর্তি সহ তিনটি মূর্তিকে গ্রামের একজনের বাড়ির বাগানে একটি প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়া অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। যা দেখে অবাক গ্রামের সকলে। মনে মনে ভাবেন মা আবার নিজের ইচ্ছায় ফিরে এলেন নিজের জায়গায়। সবাই খুব খুশী মা ঘরে ফিরে আশায়। চ্যাটার্জি পরিবারে নেমে এসেছে খুশীর হাওয়া। 

তাই আগামী বাসন্তী পূজোর দিন, দোসরা বৈশাখ মাকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে পূজো করা হবে। এই ইকড়া গ্রামের মন্দিরে ফের মা সিংহ বাহিনীর পূজো শুরু হবে। মা সিংহ বাহিনী, মহিষাসুর আর গণেশ দেবতা ছাড়া যে ইকড়া গ্রামের মানুষরা একদম অচল। সেই ভক্তি আর বিশ্বাস নিয়েই তো তারা এতদিন ধরে বেঁচে আছেন এই গ্রামে একসাথে একে অপরকে ভালোবেসে। যার সাথে জড়িয়ে গেছেন মা সিংহ বাহিনীর আশীর্বাদ আর ভালোবাসা। জয় মা সিংহ বাহিনীর জয়।

সিংহ বাহিনী মা - অভিজিৎ বসু।
তেসরা এপ্রিল, দু হাজার চব্বিশ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

জামালপুরের প্রদীপ দা

আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় বর্ধমানের জামালপুরের সেই দাপুটে ঠোঁট কাটা সাংবাদিক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এর কথা। সেই বিখ্যাত সুভাষ তালুকদার এর কাগজ সংবাদে মাত্র এক টাকার কাগজে কাজ করা সংবাদ পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক সেই প্রদীপ দা। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বাঁশের ব্যারিকেডের এপারে দূরে দাঁড়িয়েও যে খবর করা যায় সেটা বড়ো মিডিয়ার সাংবাদিকদের হাসি মুখে দেখিয়ে দিয়ে, আর তাদের খবরের ময়দানে গোল দিয়ে শুধু খবরকে ভালোবেসে ছোটো কাগজে কাজ করে চলা সর্বদা হাসি মুখের সেই আমাদের প্রদীপ চ্যাটার্জী দা।  কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে যাওয়া আর এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়া ঝোলা কাঁধে সেই খবরের খোঁজে সেই জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রদীপ দা। সেই বিখ্যাত পন্ডিত রবিশঙ্কর আর উদয়শঙ্কর এর আপন মাসতুত ভাই এর ছেলে সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় দাদা। সেই বামদের আমলে জামালপুরের এলাকায় দাপিয়ে খবর করে ছুটে বেড়ানো সেই প্রদীপ দা। সেই তৃণমূল আমলেও একভাবেই ছুটে বেরিয়ে কাজ করা আমাদের সদা ব্যস্ত প্রদীপ দা।  সেই বাবার অসুস্থতার কারনে বড়ো সংবাদ মাধ্যমে কাজ না করেও...

আমার স্যার কাজীদা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।  কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।  কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ স...

কুড়ি থালা দশ টাকা আর রসিক মুলুর জীবন

নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।  ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।  একে অপ...

শুভ মকর সংক্রান্তি

মকর মানেই নতুন জামা কাক ভোরে স্নান, রাত্রি জেগে মিঠে সুরে টুসুমণির গান। মকর মানেই পিঠে - পুলির গন্ধে ম - ম হাওয়া, ডুলুং পাড়ে টুসুর মেলায় দল বেঁধে যাওয়া। মকর মানেই মোরগ লড়াই পাহুড় জেতার সুখ, সন্ধ্যা - রাতে মাংস পিঠের স্বাদে ভরা মুখ। মকর মানেই হাতি - ঘোড়ার পুজো করম তলে, সান্ধ্য হাওয়ায় মন উদাসী দিমির দিমির বোলে। আসলে আজ এই মকর সংক্রান্তির দিন, টুসু মেলার দিন, টুসু গানে নিজেকে মাতিয়ে দেবার দিন। অজয় এর ধারে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় ভীড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেবার দিন। অজয় এর জলে ডুব দিয়ে স্নান করে পূণ্য অর্জনের দিন। আর নদীর ধারে মোরগ লড়াই এর দিন। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, সুতো লাটাই হাতে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার দিন। কেমন যেনো রাশির একটি স্থান থেকে অন্য রাশিতে স্থান পরিবর্তনের দিন। সূর্যের দেবতাকে সকালে উঠে স্নান সেরে প্রণাম জানিয়ে শক্তি সঞ্চয় এর দিন। সূর্যের উত্তর দিকে চলে যাবার দিন। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাওয়ার দিন।  এই মকর সংক্রান্তি এর ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড় রয়েছে। এটি কৃষি চক্র এবং ফসল কাটার মৌসুমের সাথে জড়িত। এই মকর সংক্রান্তি চ...