সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুঠোফোনে বন্দী নয় উত্তম

ফোনহীন জীবন উত্তমের। দেখা হলো সিউড়ির এক চায়ের দোকানে। পেশায় রাজমিস্ত্রী উত্তম সরকার। বাড়ী সিউড়ির অরবিন্দ পল্লীতে। চুপচাপ দোকানে বসেছিলেন তিনি একা একাই। বার বার পকেটে হাত দিয়ে দেখতে হচ্ছে না তাঁকে কেউ খুঁজছে কী না। ঘন ঘন কেউ ফোনে বিরক্ত করছে না কখন তিনি বাড়ী ফিরবেন বলে। তাঁর নিজের কাজের জগতের লোকজন কেউ বলছে না কাল এই জায়গায় কাজ আছে আসতে হবে তাঁকে কিন্তু একদম ফেল করা যাবে না। এক অদ্ভুত নির্লিপ্ত ভাবেই রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে আছেন তিনি ঠিক যেনো কেদারনাথের মহাদেব এর মতই চিন্তা নেই, তাড়া নেই, ব্যস্ততা নেই, দৌড় নেই, খোঁজা খুঁজি নেই, একদম কোনোও ভাবেই কারুর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তার কোনোও উপায় নেই যে তাঁর সাথে যোগাযোগ করা যাবে। সত্যিই এ এক অদ্ভুত জীবন।


এই উত্তম সিনেমার উত্তম কুমার নয়। যিনি পেশায় রাজমিস্ত্রী হলেও সত্যি উত্তম। যিনি একমাত্র এই পঞ্চাশ বছর বয়সে এসেও একদম ফোনহীন যোগাযোগ হীন একটা ব্যস্ত পৃথিবীতে সাঁতার কাটছে সে।‌ একা, একদম একাই। আর আমরা সবাই মিলে ওই একা হয়েই বেঁচে থাকতে পারছি না কিছুতেই। যে কাজটা উত্তম কত সহজেই করে ফেললো। যে কাজ সে হাসতে হাসতেই করে দেখিয়ে দিয়েছে সেটা শুনে কিছুটা আশ্চর্য হলাম আমি। চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম কই এতে আপনার অসুবিধা হয় না। এই যে লোকজন আপনাকে পাচ্ছে না। যোগাযোগ করতে পরে না তাহলে কাজের অসুবিধা হয় না। জবাব দেন সব অভ্যাস হয়ে যায় দাদা। 

এটা তো সত্যিই আজ থেকে কুড়ি বছর বা পঁচিশ বছর আগে কী আর এমন দিন ছিল। মনের কথা টেক্সট করে বলে দিচ্ছে বর বউ, ছেলে মেয়ে, এই ঘর ওই ঘর থেকে ভেসে আসছে মেসেজ উড়ে উড়ে। এক ঘরের মধ্যে সবাই ঘাড় গুঁজে ব্যস্ত কেউ কারুর দিকে তাকিয়ে নেই আর কথা নেই। যেনো এক অন্য জগতে বাস করা এক ঘরে বাস করেও। যে যার জগতে মহাবিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনমনে, আপন ছন্দে। সত্যিই এক অসাধারণ জীবন যার ছন্দে ছন্দে গেঁথে আছে মোবাইল এর নিয়ন আলোর স্পর্শ, মোবাইল এর হাতছানি। যা এড়ানো বেশ কঠিন। আর সেখানেই কেমন যেন একটু অন্য ভাবে বেঁচে থাকা এই রাজমিস্ত্রী উত্তমের। কেউ যদি খুব দরকার পড়ে মেয়েকে ফোনে বলতে পারেন। কিন্তু সেটা সব সময় নয়। তাঁকে ধরতে গেলে কাজের জন্য তাঁর সিউড়ির বাড়িতে যেতে হবে। তারপর তাঁর দেখা মিলবে। 

এই যে উত্তম বাবুকে দেখে কেমন হিংসা হলো আমার। এমন একজন মানুষ যিনি নিজেই কাউকে ধরা দেন না। যাঁর কাছে ফোন এসে বলে না লোন নাও। যাঁর কাছে ফোন এসে বলে না কাজটা হয়নি কেনো। যাঁর কাছে ফোন এসে বলে না কাল এটা করতেই হবে তোমায়। কেমন নির্লিপ্ত হয়ে এই ফোনের মায়াজাল থেকে বেরিয়ে গেছেন তিনি। যে ফোনের নিশির ডাক ভুলে যাওয়া খুব কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটা কেমন হাসি মুখে করে ফেলে দিব্যি চা খাচ্ছেন তিনি রাস্তায় এক চায়ের দোকানে বসে সিউড়ি সদর শহরে। কোনো তাড়া নেই, ব্যস্ততা নেই, বার বার টুং করে কি এলো দেখা নেই, ফেসবুকের পর্দায় কটা লাইক পড়লো আর কে কি মন্তব্য করেছেন সেটা নিয়ে কোনোও মাথা ব্যাথা নেই। শুধুই নিজের মতো করে বাঁচা।

আহা এমনটা যদি হতে পারতাম আমি। এই মুঠো মুঠো ভালোবাসার মুঠো ফোনের দুনিয়া থেকে যদি নিজেকে একটু মুক্ত করতে পারতাম আমি। সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে উত্তেজিত না হয়ে যদি স্বাভাবিক মনে করে বাঁচতে পারতাম। জগন্নাথ মন্দিরের সামনে গোধূলি বেলায় হাতে কার্ড নিয়ে যাঁরা দাঁড়িয়ে মিস্টি হেসে ছবি দিয়ে ধন্য মনে করেন সেই সব ছবি দেখতে না পারতাম তাহলে কী ভালো যে লাগত আমার। দেখতে হতো না এইসব নানা উজ্জ্বল ছবি। ভাবলাম একবার জিজ্ঞাসা করি। আচ্ছা আপনার কিছু মনে হয়না। ওঁর মুখ দেখে আর সেই প্রশ্ন করতে সাহস পেলাম না আমি একদম। 

লাল জামা পড়ে সত্যিই অসাধারণ এই ফোনহীন জীবনের মালিক সিউড়ির উত্তম সরকার। যাঁর জীবন টাকে সত্যিই আমি বড়ো হিংসা করি যেনো। এই নির্লিপ্ত জীবন, এই মোবাইল ফোনহীন মিষ্টি জীবন, এই একটা জীবন যাঁর কাছে টুং করে মেসেজ আসবে না কোনো দিন তাঁর অফিস এর বাবুর থেকে, কাজের জায়গা থেকে, আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে যেখানে সে শুধুই একা একাই হেঁটে বেড়াবেন ঘুরে বেড়াবেন বিন্দাস হয়ে জামার কলার তুলে সেই নায়ক উত্তম কুমারের মতই। ভালো থাকবেন আপনি উত্তম বাবু। এইভাবেই হাসি মুখে জীবন কাটিয়ে যান আপনি ওই মুঠোফোনে বন্দী না হয়ে।

মুঠোফোনে বন্দী নয় উত্তম - অভিজিৎ বসু।
দোসরা মে, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি আমার মোবাইলে তোলা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

জামালপুরের প্রদীপ দা

আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় বর্ধমানের জামালপুরের সেই দাপুটে ঠোঁট কাটা সাংবাদিক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এর কথা। সেই বিখ্যাত সুভাষ তালুকদার এর কাগজ সংবাদে মাত্র এক টাকার কাগজে কাজ করা সংবাদ পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক সেই প্রদীপ দা। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বাঁশের ব্যারিকেডের এপারে দূরে দাঁড়িয়েও যে খবর করা যায় সেটা বড়ো মিডিয়ার সাংবাদিকদের হাসি মুখে দেখিয়ে দিয়ে, আর তাদের খবরের ময়দানে গোল দিয়ে শুধু খবরকে ভালোবেসে ছোটো কাগজে কাজ করে চলা সর্বদা হাসি মুখের সেই আমাদের প্রদীপ চ্যাটার্জী দা।  কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে যাওয়া আর এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়া ঝোলা কাঁধে সেই খবরের খোঁজে সেই জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রদীপ দা। সেই বিখ্যাত পন্ডিত রবিশঙ্কর আর উদয়শঙ্কর এর আপন মাসতুত ভাই এর ছেলে সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় দাদা। সেই বামদের আমলে জামালপুরের এলাকায় দাপিয়ে খবর করে ছুটে বেড়ানো সেই প্রদীপ দা। সেই তৃণমূল আমলেও একভাবেই ছুটে বেরিয়ে কাজ করা আমাদের সদা ব্যস্ত প্রদীপ দা।  সেই বাবার অসুস্থতার কারনে বড়ো সংবাদ মাধ্যমে কাজ না করেও...

আমার স্যার কাজীদা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।  কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।  কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ স...

কুড়ি থালা দশ টাকা আর রসিক মুলুর জীবন

নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।  ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।  একে অপ...

শুভ মকর সংক্রান্তি

মকর মানেই নতুন জামা কাক ভোরে স্নান, রাত্রি জেগে মিঠে সুরে টুসুমণির গান। মকর মানেই পিঠে - পুলির গন্ধে ম - ম হাওয়া, ডুলুং পাড়ে টুসুর মেলায় দল বেঁধে যাওয়া। মকর মানেই মোরগ লড়াই পাহুড় জেতার সুখ, সন্ধ্যা - রাতে মাংস পিঠের স্বাদে ভরা মুখ। মকর মানেই হাতি - ঘোড়ার পুজো করম তলে, সান্ধ্য হাওয়ায় মন উদাসী দিমির দিমির বোলে। আসলে আজ এই মকর সংক্রান্তির দিন, টুসু মেলার দিন, টুসু গানে নিজেকে মাতিয়ে দেবার দিন। অজয় এর ধারে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় ভীড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেবার দিন। অজয় এর জলে ডুব দিয়ে স্নান করে পূণ্য অর্জনের দিন। আর নদীর ধারে মোরগ লড়াই এর দিন। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, সুতো লাটাই হাতে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার দিন। কেমন যেনো রাশির একটি স্থান থেকে অন্য রাশিতে স্থান পরিবর্তনের দিন। সূর্যের দেবতাকে সকালে উঠে স্নান সেরে প্রণাম জানিয়ে শক্তি সঞ্চয় এর দিন। সূর্যের উত্তর দিকে চলে যাবার দিন। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাওয়ার দিন।  এই মকর সংক্রান্তি এর ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড় রয়েছে। এটি কৃষি চক্র এবং ফসল কাটার মৌসুমের সাথে জড়িত। এই মকর সংক্রান্তি চ...