সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অমলতাসের গন্ধ মাখা হাসি যুদ্ধ নয় শান্তি চাই

শান্তিনিকেতনের সকালে এই হলুদ ফুলগুলোকে হাসতে দেখে মনে হল, যুদ্ধ তা হলে নিশ্চয় থেমেছে। চারিদিকে যা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু হয়েছিল তার ঠিক নেই। আকাশে যুদ্ধ, বাতাসে যুদ্ধ, মল্লভূমিতে যুদ্ধ, শয়নে, স্বপনে আর জাগরণে যুদ্ধ। আর এই সবের মাঝে না-হলে ওই হলুদ ফুলের ডালপালায় এত হুল্লোড় কীসের? ঝিরিঝিরি হাওয়ায় দুলছে সোনারঙের ফুল। বেশ একটা নিশ্চিন্তি ভাব যেনো ওদের। কিসের নিশ্চিন্ত সেটা অবশ্য ওদের দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। সারারাত এর ক্লান্তি কাটিয়ে মেঘহীন আকাশের গোল চাঁদ এর আলোছায়া গায়ে মেখে একটা চরম নিশ্চিন্তে নিরাপদে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যেনো। 

রবীন্দ্রনাথ এই ফুলের নাম দিয়েছিলেন অমলতাস। কি সুন্দর নাম। আমরা এদের বলতাম বানরলাঠি গাছ। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নামটা বেশ ভালো। তবে বেশ কেতাবি নাম যেনো একটু। বানরলাঠি নামের মধ্যে একটা গেঁয়ো সুর আছে। বৈশাখ মাসে পুরো গাছটা হলুদ হয়ে যায়। যখন হাওয়া বয় হঠাৎ করেই এই গাছের কাছে এলে মনে হয়, পৃথিবীতে শুধুই শান্তি আছে, যুদ্ধ নেই। সত্যিই তো সারা পৃথিবী জুড়ে শান্তির মৃদুমন্দ বাতাস বইছে চারিদিকে। যে বাতাস গায়ে মেখে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি এদিক ওদিক আর সেদিক। 

বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের মাস। যে মাস শুধুই রবীন্দ্রনাথের মাস সেই মাসে এখন কি যুদ্ধ হতে পারে? অবিশ্যি রবীন্দ্রনাথের কথা মনে রাখতে বাঙালির ভারী বয়ে গেছে। কোনওদিন মনে রাখেওনি। পিরের থানে সিন্নি চড়ানোর মতো বোশেখ পঁচিশে রবির গলায় বেল, জুঁই ঝুলিয়ে শ্লাঘায় ভরে উঠেছে বুক। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনেই যে-রকম যুদ্ধের জিগির দেখলাম তাতে আমি নিশ্চিত, কবি বেঁচে আছেন শুধু ফুলের মালা, আর দীপের আলোয়।

 এসো হে বৈশাখ উদযাপন এর মধ্য দিয়েই যেনো বৈশাখের প্রথম সকালের নতুন ভোর এর আগমন। যে ভোর বেলায় হলুদ অমলতাস এর হাতছানি, যে ভোর বেলায় ঘুম ভেঙে উঠে দেখতে পাই যুদ্ধের জিগির নেই, যুদ্ধের দামামা নেই চারিদিকে শুধুই শান্তি,শান্তি আর চরম শান্তি। আর এর মাঝে দেশের মানুষের সেবা করা মানুষদের নানা নিজের কথা আর নিজের হুঙ্কার আর গর্বের কথা। 

কথা হচ্ছিল ওই বানরলাঠি গাছ নিয়ে। সেই যে এই গাছ দেখেছিলাম পূর্বপল্লীর রাস্তায় ঘাড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে অপলক নয়নে বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসের ভিতর গা জড়াজড়ি করে। সেই যে এই গাছ সাইকেল চালিয়ে ঘুরতে ঘুরতে দেখেছিলাম রতনপল্লীর মাঠের ধারে এককোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে যেনো সে আপনমনে। যে গাছের পাতায় ও ডালে এই গ্রীষ্মেও হলুদ বসন্তের ছোপ ছোপ দাগ। যে দাগে যুদ্ধ নেই শুধুই শান্তি শান্তি আর শান্তির কথা। সত্যিই অসাধারণ তো যুদ্ধের দামামা থেমে গিয়ে শান্তির পৃথিবীর মাটিতে অন্য রকম এক ছবি। 

পূর্বপল্লীর সামনে মাঠে ফুটে উঠছে এই হলুদ ফুল।
গলায় সোনার হারের মতো ভোরের আলোয় খলবলিয়ে উঠেছে যেনো তারা। হলুদ ফুলের গায়ে শেষ বোশেখের একফালি রোদ্দুর কেমন পিছলে পিছলে পড়ছে। যুদ্ধের ভেঁপুতে সব কিছু হারিয়ে যায় না। আমার বয়স যত বাড়ছে গাছকে তত যেনো আপন মনে হচ্ছে। গাছের ডালে, পাতার ফাঁকে অনেক লোক পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। তাদের দেখা যায় না। তবে ফিসফাস আওয়াজ শোনা যায়। কেউ যেন বলে, চল, গুলি খেলবি? কিংবা দাড়িয়াবান্ধা? ওরা আমার বন্ধু। কবেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ওরা যুদ্ধ দেখেনি, যুদ্ধের কথা শোনেওনি। আমের ডালের ফাঁকে কোকিলের সাইরেন শুনেছে শুধু। যখন বৈশাখী ঝড় ওঠে, ওরা আমাকে ডাকে, আয় আয়। এত যন্ত্রণা বাতাসে মিশে আছে! 

গাছ থাকবে। গাছের গায়ে বিড়ালের আঁচড় থাকবে। গাছের গায়ে আমার মৃত বন্ধুর হাসি লেগে থাকবে। গাছের যুদ্ধ নেই। গাছ চিরবন্ধু, চিরনির্ভর, চিরশান্তি।
ছেলেবেলা থেকে যা শুনে এসেছি, আজ কি সব মিথ্যে হয়ে যাবে? ইস্কুলের পাঁচিলে ভুসো কালি দিয়ে সেই কবে, কারা যেন ছোটো বেলায় লিখেছিল, যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। কত ঝড়-বৃষ্টি-রোদ্দুর-নৈরাজ্যেও সেই কালি পুরোপুরি মোছেনি। আজ যুদ্ধের কথা বললে হাততালি জোটে বটে, কিন্তু যুদ্ধ কখনও পবিত্র হতে পারে না। ভুসোকালির লেখাটাই চিরকাল থেকে যাবে--শান্তি চাই। এই ধূলি ধূসর পৃথিবীতে শুধুই অমলতাসের হলুদ ফুলের ছোঁয়া গায়ে মেখে শুধুই শান্তি চাই। যে শান্তির কথা হাজার বছর আগে হাসি মুখেই শুনিয়ে দিলেন সেই নির্বাণ পুরুষ বোধিজ্ঞান লাভ করা বুদ্ধ। সত্যিই তো আমরা সবাই যে যুদ্ধ নয় শান্তিই চাই।

অমলতাসের গন্ধমাখা হাসি যুদ্ধ নয় শান্তি চাই - অভিজিৎ বসু ।
তেরো মে, দু হাজার পঁচিশ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ইটিভির পিনাকপাণি ঘোষ

কিছু মানুষ কত কাছে থেকেও পাশাপাশি এক জায়গায় বাস করেও একসাথে একসময় কাজ করেও যে কত দূরে রয়ে যান নিজের হাসিমুখ নিয়ে আর সেই চেনা ছন্দ নিয়ে সত্যিই বেশ ভালো মজার ব্যাপার কিন্তু এটা জীবনের মেঠো পথে। সেই ইটিভির বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে ঘুরে ঘুরে স্ট্রীট ফুডের ছবি তোলা আর নানা খবর করে খাওয়া দাওয়ার এপিসোড করে একসময়ে বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে যাওয়া ইটিভি নিউজে। আর আমাদের জেলায় বসে সেইসব হাঁ করে দেখা আর কেমন মনের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হওয়া। একেই বলে কলকাতার রাজপথের সাংবাদিক বলে কথা।  সেই যে বার রাষ্ট্রপতি এলেন জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে সেই অনুষ্ঠানের বিশেষ কার্ড জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করা ইটিভির চাকরি করার সুবাদে। কোনো রকমে সেই কার্ড জোগাড় করে এনে দেওয়া তাঁকে আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সেই একদিন দুপুর বেলায় খুব সম্ভবত করোনা শেষ পর্বে বালিঘাট স্টেশন থেকে অফিস যাওয়ার সময় এসি পঞ্চাশ এর বাস এর ভিতরে দেখা হওয়ায় কত গল্প করা দুজন মিলে পুরনো দিনের। আবার উত্তরপাড়ার সেই বিখ্যাত চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে হাসি মুখে দেখা হয়ে যাওয়া রাতের বেলায় কাঁঠালবা...

আমাদের সবার মৃনাল দা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক বাবা আর ছেলের লড়াই এর গভীর গোপন কাহিনী। এই সাংবাদিকতার পেশায় এসে কত লড়াই, কত অসম যুদ্ধ, করে যে কেউ সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে হাসি মুখে কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে। এমন করে কেউ টিকে থাকার চেষ্টা করেন সেটা বোধহয় আমার জানা হয়ে উঠত না কিছুতেই। যদি না এই পেশায় আমি গা ভাসাতাম এমন করে। জীবনের এই নানা টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভেসে ওঠে এই রাতের অন্ধকারে আচমকা আমার মনের মাঝে। আর আমি চমকে উঠি কেমন করে তাদের সেই কোলাজ দেখে।  এমন এক চরিত্র, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়ে কেমন আলগোছে, হাসিমুখে, নির্মোহ ভাবে, শুধু নিজের কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো সে শুধুই আকাশ পানে তাকিয়ে। যে নীল আকাশের গা ঘেঁষে উড়ে যাওয়া সাদা বকের ডানায় লেগে থাকে মেঘের হালকা টুকরো। একদম যেনো সিনেমার পর্দার হিরোর মতোই। দেখে বোঝার উপায় নেই একদম। পেটে খাবার না থাকলেও মুখের হাসিটা অমলিন হয়েই বেঁচে আছে আজও এতোদিন পরেও। আর সেই বিখ্যাত সাদা পাকা নাসিরউদ্দিন স্টাইলের দাড়ি, কালো চুল, আর সব সময় ধোপদুরস্ত ফিটফাট একজন মানুষ। রাত নটা বাজলেই যাকে শ্রীরামপুরে...

শপিং মলের উদ্বোধনে সিঙ্গুর আন্দোলনের দাপুটে মন্ত্রী

নালিকুল স্টেশন বাজারে একটি শপিং মলের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বেচারাম মান্না হাজির। একসময় যাঁর অন্দোলনের ঠেলায় পড়ে দৌড়ে একপ্রকার পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা কোম্পানিকে। যে আন্দোলনের দগদগে ঘা আর সেই স্মৃতি ধীরে ধীরে আজ প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের কাছ থেকে। আজ সেই চাষার ঘরের মানুষ না হলেও সেই কৃষক আর শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন সেই মানুষটাকেই কেমন যেন আজ শপিং মলের উদ্বোধনে দেখে বেশ ভালই লাগলো আমার।  একদম নালিকুল স্টেশনের কাছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল। দোকানে সাজানো জিনিস পত্র। আর সেখানেই আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বেচারাম মান্না। একদম কেমন একটু আমার অচেনা লাগলো যেন। সেই মুড়ি খেয়ে আলুর তরকারি বা শশা খেয়ে আন্দোলন শুরু করা জমি আন্দোলন এর অন্যতম পথিকৃৎ নেতা আজ এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তাহলে টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে যে জমি দখল নিয়ে আন্দোলন সেই আন্দোলন এর মধ্যে ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। যদিও সেখানেও সেই সময়ের শাসকদলের কর্মসংস্থানের যুক্তি।তবে এই নতুন শপিং মলের উদ্বোধনে তো আর ...

ভীড়ের মাঝে একা

জীবন জুড়ে শুধুই ভীড় আর ভীড়। নানা ধরনের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় মানুষের গন্ধে, বর্ণে , স্বাদের ভীড়ে আমি একদম একা হয়ে যেতে চাই। যে ভীড় উপচে পড়া রাস্তায় শুধুই হেমন্তের ভোরে শিশিরের ফিসফিস শব্দ, পাখির কিচির মিচির আওয়াজ,ধানসিড়ি ওই নদীটির তীর ধরে ঘুঘুর আকুল মন কেমন করা ডাক, উদাসী শালিকের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া ওই হেমন্তের হলুদ ধানের মাঠ এর পাশ দিয়ে, হলুদ বসন্ত বৌরীর সেই আমলকীর গাছের পাতায়,আড়ালে আবডালে বসে কেমন যেন আমায় দেখে লজ্জা পাওয়া, আর তারপর চোখ নামিয়ে হঠাৎ করেই তার উড়ে চলে যাওয়া। আর মেঘের কোল ঘেঁষে সেই সাদা বকের, বুনো হাঁসের, আর সেই পানকৌড়ির জলে ভেজা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া আকাশ জুড়ে। সত্যিই ওরাও যে ভিড়ের মাঝেই বড়ো একা। একা একাই ওদের যে এই বেঁচে থাকা। কেমন নিপাট হৈ চৈ হুল্লোড়হীন একটা জীবন নিয়ে বেশ মজা করে, আনন্দ করে। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে রাস্তার একপাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা ওই সাদা কালো ভুলো নামের কুকুরের। যে অন্তত এই সব মানুষদের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একটু যেনো আলাদা , একটু যেনো অন্য রকমের। একটু একা একাই যেনো ওর এই আলগোছে জীবন কাটিয়...

গৌড় প্রাঙ্গণে আনন্দবাজার

গৌরপ্রাঙ্গনে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের আনন্দের মেলা আনন্দবাজার। মহালয়ার ভোরবেলায় ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের মন কেমন করা সুরে মেতে উঠলো শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গণ। প্রতি বছরের মতো এই বছরও যে হবে আনন্দমেলা আনন্দবাজার। হ্যাঁ সত্যিই যেনো আনন্দের এই হাটে বেচাকেনার পসরা নিয়ে একদিনের জন্য বসে পড়া মন প্রাণ খুলে হৈ হুল্লোড় করে। এই মেলা শুরু হয় 1915 সালের 15 এপ্রিল নববর্ষের দিনে। কিন্তু আগে এই মেলাকে একসময় বলা হতো বৌঠাকুরাণীর হাট। সেই সময় আশ্রমের মহিলারা নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসতেন। মেলার আয়োজন করতেন তারা। আনন্দ করে বেচাকেনা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় একবার গরমের ছুটির আগে এমন মেলা নাকি হয়েছিল। যার নাম ছিল আনন্দবাজার। পরে এই মেলার নামে হয়ে যায় আনন্দমেলা। সত্যিই আনন্দের এই মিলন মেলা।  প্রথমদিকে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মেলা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বভারতীর সব বিভাগের পড়ুয়ারা এই মেলায় যোগদান করে। এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের বেচা কেনার লাভের টাকার কিছু অংশ জমা পরে বিশ্বভারতীর সেবা বিভাগে। সেখান থেকে এ...