সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন, কাগজের সাদা কালো অক্ষরে একটা কাজের হাতছানি, রঙিন তিলোত্তমার সেই সুন্দর ঝকঝকে ক্লাসিফায়েড বিজ্ঞাপন দেখে বিগলিত হয়ে যাওয়া, we are hiring বলে মৃদু আলতো স্বরে তন্বী সুন্দরীর মিস্টি ডাক, সেই চ্যানেলের ভীড়ের মাঝে গিরগিটির উঁকি মারা এদিক ওদিক থেকে ঘাড় উঁচিয়ে আলগোছে দেখা চোখ পিটপিট করে। পকেটে চুপ থাকা মুঠো ফোনে বন্দী এলোমেলো, এলেবেলে, বিন্দাস গ্রাম্য জীবনের হঠাৎ করেই কেমন বদলে যাওয়া একটা দ্রুত গতির বন্দে ভারতের মত ছুটে চলা জীবন। যে জীবনের শেষ অধ্যায়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের শেষ বেলায় হঠাৎ করেই চারিদিক থেকে আগমন। দীঘা বা পুরীর সমুদ্রের মতো থিক থিক করা উপচে পড়া ভীড় আমার জীবনের সফেন তরঙ্গে। আমি কেমন যেন বিহ্বল হয়ে যাই এই বুড়ো বয়সেও।
এইসব দেখেই আমার সেই ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে যায় আমার। সেই কবে ত্রিশ বা তার বেশি সময় আগে সাংবাদিক হতে চান বিজ্ঞাপন এর হাতছানি এড়াতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়া আমার। পতঙ্গের মতই আলোর মাঝে লাফিয়ে পড়া কিছু না বুঝেই। আর ডানা ঝাপটে ঝলসে যাওয়া সেই আগুনের উত্তাপে। সেই থেকেই কেমন যেনো এই নিশির ডাকে সাড়া দিতে আমার মন চায় বারবার। মনে হয় আমার সত্যিই তো কি দরকার ছিল এই আবার নতুন করে আমার এলোমেলো এলেবেলে বিন্দাস জীবনকে ব্যস্ত করার।
যে জীবনে উপেক্ষা আর অসহায়তা ছিল আমার নিত্য সঙ্গী। যে জীবনে জড়িয়ে ছিল দুঃখ, কষ্ট আর নানা কুরুচিকর অপমান। যে জীবনে হারিয়ে গেছিলো কত মুখ, কত চেনা হাসি, চেনা কণ্ঠস্বর। যে জীবনে হারিয়ে গিয়েছিল আরও আরও অনেক কিছুই। হারিয়ে গিয়েছিল নিজের অস্তিত্ব, হারিয়ে গিয়েছিল নিজের আত্মবিশ্বাস, হারিয়ে গিয়েছিল সংসারের মানুষের কাছে নিজের গুরুত্ব। হারিয়ে গিয়েছিল চেনা বন্ধুত্ব, যে টোটো চালকের জীবনে জড়িয়ে ছিল তিন চাকার টোটোর দুলকি চালে চলা একটা নিস্তরঙ্গ কোনোও রকমে যাপন করা জীবন।
আজ হঠাৎ করেই কেমন জাদু কাঠির পরশে বদলে গেছে আমার এই আঁকিবুঁকি ছন্দময় গদ্যমাখা সেই জীবন। যে জীবনকে দেখে আমার কেমন ভয় হয় এই ভোরের বেলায়। যে জীবনে আমলকীর বন্ধুত্ব, কঙ্কালীতলার সেই গাছের তলায় প্লাস্টিক পেতে পণ্য সাজিয়ে দু চার টাকা রোজগার এর আশায় হা পিত্যেশ করে বসে থাকা, সেই দুপুর বেলায় দীর্ঘ রাস্তা ধরে সাইকেল চালিয়ে ঘরে ফেরা ক্ষিদে পেটে। হাঁফিয়ে পড়লে তালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়া। মিষ্টি পাকা তালের গন্ধ, বাবুই পাখির আপনমনে দৌড়ে এসে বাসায় ঢুকে পড়া, ধূসর মাঠের কোণে সাদা বকের উড়ে যাওয়া। এসব দেখেই এক পেট ক্ষিদে চেপে ঘরে ফেরা। শক্ত হাতে সাইকেল এর স্টিয়ারিং হয়না জানি তবু বলতে ক্ষতি কি। ঘরে অপেক্ষায় আমার পরিবার ক টাকা রোজগার করতে পারলে ভালো বলা আর না হলে চুপটি করে লজ্জায় ঘরের এক কোণে লুকিয়ে পড়া আমার ভেঙে পড়া ক্ষয়িষ্ণু শিরদাঁড়াকে সম্বল করে। যে জীবনে শুধুই ওই শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলি বলে জানান দেওয়া আর হুঙ্কার দেওয়া। আর সেটা শুনে ঘরে আর বাইরে উচ্চ স্বরে হাসির পাত্র হয়ে বেঁচে থাকা।
সেই পুরোনো দিন এর জীবন হঠাৎ করেই কেমন বদলে যাওয়া। টোটো চালকের জীবন থেকে উচ্চ পদের জীবন। যে পদের মোহ আমার কোনোকালেই ছিল না কোনওদিন। যে জীবনের ছন্দ, যে জীবনের সাদা কালো অক্ষর আর ক্লাসিফায়েড এর মিষ্টি মধুর সুবাস আমায় কেমন যেনো আচ্ছন্ন করে রাখে সারাটা দিন। সেই কাগজের বিজ্ঞাপন, সেই চ্যানেলের ভুল লেখা একটি অশিক্ষিত we are hiring এর ছোটো ছোটো শব্দে লেখা বিজ্ঞাপনের অমোঘ আকর্ষণ আমায় বিচলিত করে। ঘন ঘন প্রস্রাব এর মত ঘন ঘনও মিটিং আমার এখন নিত্যসঙ্গী। সেই কত মানুষের উদ্বেলিত জীবন আমায় বিমোহিত করে। মনে মনে আমি সত্যিই ফিরে যাই সেই কবে কার ফেলে আসা জীবনে। যে জীবনে জড়িয়ে ছিল ব্যস্ততা। যে জীবনে দৌড় ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। আজ সেই আমার সাদা জীবনের কালো কথায় আমার আঁকিবুঁকি ব্লগের পাতায় সেই জীবনের কথাই লিখে ফেললাম আমি।
যে দ্রুত গতির জীবন আমি আর চাইনা একদম। সেই ভিড়হীন ভার্জিন জীবন বেশ ভালো। সেই টোটো চালকের পুরোনো দিনের নিস্তরঙ্গ একটা জীবন। সেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল বেলায় ক্ষিদে চেপে সাইকেল চালিয়ে ঘরে ফেরা একটা জীবন। সেই নানা জনের অপমান আর উপহাসের জীবনটাই বোধহয় বেশ ভালো ছিল। সেই মধুদার মতোই নির্মোহভাবে কাটিয়ে দেওয়া একটা জীবন। কাউকে ধরা না দিয়ে একা একদম একাইকোনরকমে বেঁচে থাকা একটা জীবন।
সত্যিই অসাধারণ এই জীবন আর সেই জীবনের নানা অধ্যায়। যাকে আঁকড়ে ধরে আমাদের ওই গিরগিটির মতই বেঁচে থাকা একা একদম একা। আর ক্ষমতার স্বাদ পেতে উৎসাহী হওয়া। ভোরের আলোয় ঘরের কোণে টিকটিক করে ডেকে ওঠা দেয়াল বেয়ে এগিয়ে চলা সাদা ধূসর রঙের ওই আমার চেনা টিকটিকি যে আমার সাথে বাস করে বহুদিন ধরেই। আমার দিকে তাকিয়ে বলে এই সব নিয়েই তো আমাদের জীবন। বলেই কেমন হারিয়ে যায় সে ঘরের কোণে চুপিসাড়ে। আর আমি তরঙ্গহীন জীবন নিয়ে ভোরের আলো গায়ে মেখে চুপটি করে বিছানায় শুয়ে থাকি। মাথার ওপর ঘড়ঘড় করে ফ্যান ঘোরে। আর আমি মনে মনে বলি ফিরিয়ে দাও আমার সেই এলোমেলো, এলেবেলে, বিন্দাস একটা জীবন। যে জীবনকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি।
এলোমেলো এলেবেলে বিন্দাস জীবন - অভিজিৎ বসু।
২২ শে মে, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন