"পিজি থেকে Pacemaker বসিয়ে ফিরেছি ছেলেদের কাছে। আপাতত ঘরবন্দি। পেসমেকার শুধুই আমার অবসন্ন হৃদয়ে যান্ত্রিক স্ফুলিঙ্গের যোগান দিতে। পিজির পাঁজি মেনে ছেলেরা একমাস পরে আঞ্জিও করাবে কিনা তা ঠিক হয়নি। ওটা করে নাকি জানা যাবে বাইপাস না স্টেন্ট কোনটা আমার হৃদয় সইবে। আমি বাইপাস একান্ত জরুরী হলে ভেলোর বা ব্যাঙ্গালোর যেতে আগ্রহী। ডাঃ দেবী শেঠীর সংগে যোগাযোগ করেছি। উনি যেতে বলেছেন। ছেলেরা কলকাতায় করাতে চায়।কোথায় কবে কিভাবে এতকালের জমে ওঠা যাপনের ক্লেদ থেকে শর্তহীন মুক্তি পাব জানি না। নাকি অবশিষ্ট আয়ু উদ্বায়ু হওয়ার আগে জীবন - মৃত্যুর মাঝে মাইনফিল্ডে হাঁটা ই আমার নিয়তি! সেটা এখনো জানি না। তোমরা ভালো থেকো।"
মধুদার হাসপাতাল থেকে ফিরে এটাই ছিল আমার কাছে ওনার লেখা শেষ কিছু কথা। তোমরা ভালো থেকো। আমাদের সবাইকে ভালো থেকো বলে নির্মোহ মধুদা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন অমৃত লোকে। আমি জানি না স্বর্গ আর নরক বলে কিছু আছে কি না। শুধু এটা জানি বাংলা সংবাদ মাধ্যমে একজন মানুষ আদর্শকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মানুষ। যিনি এই পেশায় থেকেও কোনোভাবেই নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারেন নি কারুর কাছে। হেসে বলেছেন ওই সব ক্ষমতা দখল করে এগিয়ে চলা সাংবাদিকদের থেকে আমি একটু দূরেই থাকি অভিজিৎ। ওসব আমার দ্বারা হবে না।
সেই কবে থেকেই তো কলকাতা থেকে অনেকেই আমায় বলেছেন মধুদাকে খুঁজে বের কর তুই। মাঝে মাঝেই কথা হয়েছে আজ দেখা হবে। কিন্তু দেখা করা হয়নি। একদিন দেখা হলো সেই এক নাচের অনুষ্ঠানে। মধুদা এলেন সাইকেল নিয়ে। কথা হলো তাঁর সাথে। গল্প হলো। বাড়ি ফিরলাম দুজনে একসাথে। সেই দাড়ি মুখ, উজ্জ্বল দুটি চোখ, সেই সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ান তিনি এদিক ওদিক। রতনপল্লীর মাঠ, পূর্বপল্লীর মাঠ। সেই কালোর চায়ের দোকান। নানা জায়গায় মধুদার ঠেক। কত মানুষ যে তাঁকে ভালোবাসেন এই বোলপুরে।
আজ কী যে লিখবো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এলোমেলো ভাবনা চিন্তা কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সেই দুজনের চায়ের দোকানে আড্ডা মারা। সেই ফোনে একে অপরের কাছে নিজেদের জীবনের গভীর গোপন কথা বলে ফেলে হালকা হওয়া। কান্নায় ভেসে যাওয়া মধুদার গলা অভিজিৎ কিছু মনে করো না ভাই তুমি। সেই স্ত্রীকে একটু ভালো রাখতে না পারার যন্ত্রণা তাঁকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কুড়ে কুড়ে খায়। যে কথা বলতে গিয়ে তিনি কেমন যেনো থমকে যান।
আজ সকালে মধুদার জীবন থমকে যাওয়ার খবর পেলাম আমি। যা বিশ্বাস করতে এখনো পারছি না আমি। হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফিরে এলেন তিনি। বললেন এই ঘরবন্দী জীবন একদম ভালই লাগছে না তাঁর। একমাস এই জীবন কাটিয়ে বড়ো ডাক্তার এর সাথে কথা হবে। তারপর ঠিক হবে কী করা হবে তাঁকে নিয়ে। আর এইসবের মাঝেই কেমন চুপটি করে হাসতে হাসতে মধুদার চলে যাওয়া চুপি চুপি।
একদিন যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন সমাজ বদলাবার। একদিন যেমন জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে বন্দুক, বিপ্লব এইসব নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। কলম ধরেছেন দেশের মাওবাদ নিয়ে। আবার সেই মানুষটাই কেমন করে যেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় শহরে এসে তাঁকে নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিলেন গবেষণা করে। স্ত্রী কে হারিয়ে কিছুটা একাই হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দুই ছেলে বাইরে থাকে। তবু কাউকে কিছুই বুঝতে দিতেন না তিনি। তাঁর কথায় আমি কাউকে বিরক্ত আর বিব্রত করতে চাই না।
সেই মধুদাকে নিয়েই আমি লিখলাম আমার ব্লগে। যিনি সারাটা জীবন যাপন করলেন অতি সাধারণ হয়েই। ক্ষমতা দখল করে রাজনীতির লোকদের খুব কাছে থেকেও কেমন যেন একটু আলগোছে জীবন কাটিয়ে দিলেন তিনি। কারুর কাছে নিজের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার কথা না বলেই। আসলে মধুদা এই ধরনের মানুষজন বোধহয় এমন হয়। সেই ওনার বাড়ী ওলার নাতির জন্মদিন বাংলা টিনটিন এর বই কিনে দেবার কথা বললেন আমায়। বই দুটো পেয়ে বললেন ওই বাচ্চা দুটো আমার বেশ ন্যাওটা হয়েছে। বই পেয়ে খুশি হবে ওরা বুঝলে অভিজিৎ।
সেই সাইকেল চালিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়ানো, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে বসে থাকা। রিসার্চ এর কাজ করা পড়াশোনায় ব্যাপৃত থাকা। আর নিজের জগতে বেঁচে থাকা মধুদা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন দুরে অনেক দূরে। খুব বেশীদিন আলাপ নয় আমাদের। তবু আজ সকালে এই খবর পেয়ে মনে হলো সত্যিই একজন আদর্শকে আঁকড়ে ধরা মানুষ। যিনি সারা জীবন যাপন করলেন আদর্শকে আঁকড়ে ধরেই। কাউকে কিছু না বলেই। সেই মানুষটা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অমৃতলোকে।
আমি জানি না স্বর্গ বা নরক বলে কিছু আছে কি না। নিশ্চয়ই মধুদা স্বর্গেই যাবেন। তবে এত দ্রুত সেটা বুঝতে পারিনি আমি। ভালো থাকবেন আপনি দাদা। আর কোনদিন আপনার সাথে ঘোরা হবে না সাইকেল করে একসাথে এই মেলা মাঠে, রতনপল্লীতে বা গুরু পল্লীর রাস্তায়। সেই আমায় বলতেন অভিজিৎ আমি তো চাকরি করতেই পারতাম না খালি পকেটে রেজিগনেশন লেটার নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। ঠিক ভাবে সংসারে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি আমি কোনো দিন। ওনার কথা শুনে মনে মনে নিজেও লজ্জা পেতাম আমি।
সেই তাঁর শেষ লেখা লাইন জীবন আর মৃত্যুর মাঝে মাইনফিল্ডে হাঁটাই আমার নিয়তি। মধুদা হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন দূরে অনেক দূরে। যেখানে আর কোনও দিন আমি তাঁকে যখন তখন ফোন করে বলতে পারবো না মধু দা সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনোও চিন্তা নেই আপনার। ছেলেদের কাছে থাকুন সুস্থ হলে নিশ্চয়ই শান্তিনিকেতনে আপনি আবার ফিরে আসবেন। না, মধুদার তাঁর প্রিয় প্রাণের জায়গা শান্তিনিকেতনে আর ফেরা হলো না। ভালো থাকবেন আপনি দাদা। আমার প্রনাম নেবেন।
ভালো থাকবেন মধু দা - অভিজিৎ বসু।
পনেরো মে, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন