সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার এই দৌড়হীন জীবনে আর বৃষ্টিভেজা দুপুরে তাল তুলে সময় কাটানোর কথা। কাল জন্মাষ্টমী। প্রভু শ্রী কৃষ্ণের জন্ম দিন। বাজারে তাল এর ডিমান্ড বেশ চড়া। আসলে প্রভুর ভোগের জন্য যে তাল এখন বেশ উচ্চদামে বাজারে বিকোচ্ছে। তাল এর গন্ধে আমার মেয়ে নাক সিঁটকে বলে আবার এই তাল ঘরে এনেছে। সত্যিই আর পারা যায় না যে।
কিন্তু এমন একটা দিনক্ষণ আমার জীবনে আসবে সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি বিশ্বাস করুন আপনারা। রাস্তার দুধারে পাকা তালের গন্ধে মাছি ভন ভন করছে। কিন্তু কেউ সেটা দেখেও দেখছে না। হাতে তুলেও নিচ্ছে না। তার ওপর আবার শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনের আগের দিন। বোলপুর থেকে সাইকেলে করে আজ যখন মা কঙ্কালীতলার মন্দিরে আসছিলাম হাটে বসবো বলে।রাস্তায় বেশ অনেকেই তাল নিয়ে বসে আছেন দেখলাম। তখন ভাবলাম আজ কি আর রাস্তার পাশে পড়ে থাকবে এই তাল এইভাবে এদিক ওদিক। প্রভুর ভক্তরা সব সাফ করে দেবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু না সাফ করার পরেও যে রাস্তার পাশে এইভাবেই তারা পড়ে আছেন মনে হয় আমার জন্যে। তাই কোনো কিছু পরোয়া না করে ব্যাগে নিলাম ওদের পরম যত্নে ঠিক যেভাবে বৃষ্টি ভেজা রাতে মাথায় করে প্রভুকে পৌঁছে দিয়েছিলেন নন্দলাল। সাথে ছিল বাসুকির সাহায্য। সে গল্প তো সবার জানা।
মাথার ওপর টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। ভিজছে তাল গাছ চুপটি করে আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে। কতদিন যেন ওরা স্নান করেনি। বাধ্য ছেলের মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ভিজে। আমিও রাস্তার পাশে হলুদ এক ফুলের গাছের নিচে বসে আছি। বৃষ্টি থামলে এগোবো। না কোনো তাড়া নেই যে আমার। সামনে ভেজা রাস্তায় অলস চোখে দূরে তাকিয়ে ওই কুকুর কেমন আনমনা।
ভেজা মাথায় সবজে কাপড় তুলে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরছে মাঠে কাজ সেরে গ্রামের মহিলারা। ফাঁকা রাস্তায় টিপটিপ বৃষ্টির ফিসফিস শব্দ। রাস্তায় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির ছোঁয়া। অলস দুপুরে গাছের ফাঁকে নাম না জানা পাখির বিধুর ডাক। ভেজা ডানার জল শুকোতে শুকোতে সেও হয়তো এমন গজগজ করছে। যেমন তাল নিয়ে ঘরে আসছি শুনে আমার মেয়ে গজগজ করছে বাড়িতে। বলছে ঘরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না কোনো মতেই।
সত্যিই কি যে বলছে ওই পাখির দল ওদের ভাষায় কে জানে। নিস্তরঙ্গ রবিবারের দুপুরে কেমন যেন এই অলসতার সুস্পষ্ট ছোপ ছোপ দাগ আমার সারা গায়ে। একসময় তো এই আমি রবিবার এর দিনের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকতাম। সপ্তাহের এই একটা দিন একটু কম দৌড়তাম আমি। ব্যস্ত জীবনের তো এই ভাবেই কেটে যেতো দিন। কই কোনোদিন তো পাখির জলে ভেজা ডানা শুকোনোর সময় এমন রাগ করে গজগজ করতে শুনিনি আমি কোনোদিন দুপুরবেলায় একা একা বসে। কই জন্মাষ্টমী উদযাপন এর আগের দিন রাস্তার পাশে তাল তুলে ঘরে ফেরা হয়নি আমার। একবুক টাটকা বাতাস গায়ে মেখে ভেজা বৃষ্টির ছোঁয়া নিয়ে সাইকেল চালানো হয়নি।
সত্যিই ওই সেই কবিতার বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই এর মত অনেক কিছুই বোধহয় করা হয়নি আমার এই পোড়া জীবনে। বাবুমশাই তো শুধু সাঁতার কাটা জানতেন না। সেই প্রবল ঝড়ে যখন নৌকো টলমল করছে তিনি মাঝিকে বলেন না তিনি সাঁতার জানে না। আমিও যে অনেক কিছুই জানতে পারিনি। দেখতে পারিনি। শুনতে পাই নি।
সেই যে হাওয়াই জাহাজে চড়ে আমার আকাশে ওড়া হয়নি কোনোদিন কোনো সময়। সেই সেক্টর ফাইভের এগারো তলার ঝাঁ চকচকে মিডিয়ার অফিস থেকে পনেরো তোলার অফিসে কাজে যোগ দেওয়া হয়নি। বউকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণ বা বিদেশ ঘোরা হয়নি কোনো দিন। আইফেল টাওয়ার এর সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে ছবি তুলে পোস্ট করা হয় নি। কত কিছুই তো জীবনে করা হয় নি আমার।
তবু এই রোববারের দুপুরে আজ তাল তোলার অছিলায় কত কিছু যে দেখে ফেললাম, অবাক হয়ে শুনে ফেললাম কে জানে। বন্ধু সমীর এর কথায় তোকে তালের ঘোরে ধরেছে। সত্যিই তো জীবনের এই অনুষঙ্গ, অলস কর্মহীন রবিবারের দুপুর আমায় নতুন করে বাঁচার রসদ সরবরাহ করলো। নতুন করে জীবনের দর্শন করালো। বৃষ্টি থেমে গেছে এইবার আবার আমি সাইকেলে প্যাডেল করে ঘরে ফিরতে শুরু করলাম। যে ঘরে গজগজ করলেও অপেক্ষায় আছে আমার সেই ছোট্ট মেয়ে বুটা।
রবিবারের দুপুরে তাল তোলা - অভিজিৎ বসু।
পঁচিশে আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন