ঘণ্টাকর্ণ পুজো বা ঘেঁটু পুজো বা ঘেঁটু উৎসব
বসন্তে রাস্তার ধারে, ঝোপঝাড়ে,পড়ে থাকা জমিতে এই ঘেঁটু ফুল ফোটে এর অন্য নাম ভাঁটফুল। যে ফুলকে অনেকে বন জুঁইও বলে। এই ফুল নিয়েও লিখেছিলেন বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ।
বেহুলার পায়ে বেজেছিল, 'বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।'
সত্যিই ঘুঙুরের মতই যেনো দেখতে। ঝন ঝন করে বাজে আর সেই বাজনা শুনে ছুটে আসে মৌমাছির দল সার বেঁধে। ফুলের ওপর বসে তারা মধু পান করে আনন্দে। ম্লান সবুজ খসখসে পাতার ডালের আগায় ধপধপে সাদা সাদা ফুল ফুটে আছে। মাথা দুলিয়ে একে অপরের গায়ে পড়ে খিল খিল করে হাসছে যেনো। প্রত্যেকটি ফুলে তিন-চারটি সাদা লম্বা কেশর সৌন্দর্যের হিল্লোল তোলে হাওয়ার দোলায় আর বসন্ত বাতাসে। বাংলার রূপ মেলে ধরে প্রথম বসন্তে। হাওয়ার ঝরনার স্রোতে ভেসে আসে ভোমরা, মৌমাছি, প্রজাপতি শুধু এই বন জুঁই এর টানে।
শহরের মানুষরা এই পুজো বা উৎসব সম্পর্কে বিশেষ না জানলেও, ফাল্গুন সংক্রান্তিতে পশ্চিমবাংলায় কোথাও কোথাও এখনও ঘেঁটু উৎসব হয় বিশেষ করে গ্রামে গঞ্জে। এটি আসলে শিব-পার্বতীর পুজো। ঝুড়ি বা হাঁড়ির উপর এক পাশে গোবরের সাহায্যে কড়ি দিয়ে চোখ-মুখ ও দেহের অবয়ব দান করে বিগ্রহ তৈরি করে সকালে এই পুজো করা হয়। ঝুড়ির ভেতর ঘেঁটু ফুল সাজিয়ে দেওয়া।
বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘেঁটু ফুল সংগ্রহ করে। এরাই ঘেঁটু পূজারি। ওই দিন সন্ধে বেলায় তারা কলা গাছের ঘর বানিয়ে (এছাড়া নিজেরাই বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয় মানে বহুরূপী হয়ে) আর তাতে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে সেটা কাঁধে করে নিয়ে গোটা গ্রামে গৃহস্থের ঘরে ঘরে ঘুরে এরা ঘেঁটু পূজার গান গায়। ছোটো বেলার সেই গান আজ শহুরে জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও গ্রামের জীবনে আজও তা বেঁচে আছে।
বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ছড়া প্রচলিত আছে। যেমন:-
'চাল ডাল মুলো বড়ি
ঘেঁটু এল গেরস্ত বাড়ি
চাল দাও গো...'
বা কোথাও -
'ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায় গৃহস্থের বাড়ি
ঘেঁটুকে দাও গো পয়সা কড়ি।
যে দেবে মুঠো মুঠো,
তার হবে হাত ঠুঁটো
যে দেবে থালা থালা
তার হবে সোনার বালা।
যে দেবে বাটি বাটি
তার হবে সাত বেটি
যে দেবে মড়াই মড়াই
তার দুয়ারে সোনা ছড়াই।
বা কোথাও বলা হতো -
এক কাঠা চাল দাও কুমড়োর বড়ি
যে দেবে থালা থালা তার হবে কোঠা-বালা
যে দেবে মুঠো মুঠো তার হবে হাত ঠুটো
যে দেবে এক পলা তেল তার হবে সোনার দেল'।
আর এই ছড়া কেটে ঘুরে ঘুরে গৃহস্থের বাড়ী থেকে কিছু সংগ্রহ করা। ছোটো বেলার সেই খেলা, সেই পূজো আজ বড়ো মনে পড়ে যায় আমার। আজকাল মোবাইল দাপটের যুগে কি আর এসব চলে। হাতের মুঠোয় পৃথিবী এসে গেছে সেখানে আর এসব পুজোর কথা ভেবে বলে কি লাভ বলুন। তবুও আজ ঝোপ ঝাড় জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার মতোই এই সব গ্রাম্য পূজো আজও বেঁচে আছে অমলিন হয়ে।
জানা যায় ঘণ্টাকর্ণের বিয়ে হয়েছিল বসন্ত-বিষফোঁড়া ইত্যাদি রোগের দেবী শীতলার সঙ্গে। আর বসন্তকালে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। আর কী আশ্চর্য তাঁর স্বামীর নাম ঘণ্টাকর্ণ। এই ঘণ্টাকর্ণ, ঘেঁটু বা ভাঁটে জ্বর, চর্মরোগ, বিছের হুল ফোটানোতে ওষুধের কাজ করে। এমনকি ম্যালেরিয়া জ্বরে, পাণ্ডু রোগে, অজীর্ণে এর রস ওষুধ হিসেবে ভালই কাজ করে।
আর এই জন্য চৈত্রসংক্রান্তিতে ঘণ্টাকর্ণ বৃক্ষের আরাধনা করা হয় চর্মরোগ নিবারণের জন্য। এখনো প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ জ্বর হলে এর পাতার রস খেয়ে থাকে। তবে আগে যেভাবে হত এখন তার অংশ বিশেষ দেখা যায়। আর ছোটখাটো বাঙালী পার্বণের মত এটিও লুপ্তপ্রায়।
এত গেলো ইতিহাস এর কথা, এবার আসি উদ্ভিদ বিজ্ঞান কি বলে সে কথায়। বিজ্ঞানের ভাষায় কি বলা হয় একে, সেটা হলো এই ভাঁট, ভাইট, বনজুঁই বা ঘেটু গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী সপুষ্পক উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম Clerondendron viscosum। এটি গ্রামবাংলার অতি পরিচিত একটি বুনো উদ্ভিদ। ভন্টাকি (ঘেঁটু) বা ভাঁট চৈতঘাড়া ফুল। ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ ও মায়ানমার অঞ্চলে এদের দেখা যায়।
ভাঁট গাছের প্রধান কাণ্ড একেবারে সোজাভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। সাধারণত ২ থেকে ৪ মিটার লম্বা হয় এই গাছ। পাতা ৪ থেকে ৭ ইঞ্চি লম্বা হয়। দেখতে কিছুটা পানপাতার আকৃতির ও খসখসে। ডালের শীর্ষে পুষ্পদণ্ডে ফুল ফোটে। পাপড়ির রং সাদা এবং এতে বেগুনি রঙের মিশেল আছে। বসন্ত থেকে গ্রীষ্ম অবধি ফুল ফোটে। এই ফুলের রয়েছে মিষ্টি একটা সৌরভ।
ফুল ফোটার পর মৌমাছিরা ভাঁট ফুলের মধু সংগ্রহ করে। গ্রামের মেঠো পথের ধারে, পতিত জমির কাছে এরা জন্মে থাকে এবং কোনরূপ যত্ন ছাড়াই প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠে এই বুনো গাছটি। এছাড়াও পাহাড়ি বনের মাঝে এবং পাহাড়ি রাস্তার পাশে এদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষনীয়।
ভাঁট গাছ ঔষধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ। এর পাতার রস শিশুর জ্বর দূর করে। এছাড়াও সনাতন ধর্মালম্বীরা ভাঁট ফুল দিয়ে ভাঁটি পূজার আয়োজন করে থাকে।
ঔষধির কাজে ব্যবহার করা হয় একে। এতে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে। ফ্ল্যাভোনয়েড থাকার জন্য এটি ক্যানসার দমনে সহায়ক। এছাড়াও কৃমি, চুলকানি, কোলেস্টেরল, ব্লাড সুগার ও উদরাময় প্রভৃতি রোগ নিরাময়ে এটি সাহায্য করে। তবে এটি খুব বেশি স্বীকৃত নয়।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতায় ভাঁট গাছের প্রসঙ্গ এসেছে, কবি লিখেছেন।
“ ভাঁট আঁশ শ্যাওড়ার বন
বাতাসে কী কথা কয় বুঝি নাকো, বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে;
পৃথিবীর কোনো পথে দেখি নাই আমি, হায়, এমন বিজন।
সত্যিই এই বুনো ফুল নিয়েও কবির যেনো স্বপ্নের সৃষ্টি। যে সৃষ্টি আজও ঘুঙুরের মত বাজে বসন্তের মায়ামাখা সকালে। কোকিলের মন কেমন করা ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গে প্রজাপতির আর মৌমাছির। ছুটে আসে মৌমাছি আর প্রজাপতির দল ফুলের পরাগ গায়ে মেখে লুট পুটি খায় একে অপরের উপর।
দূরে মন্দিরের রাস্তায় শোনা যায় ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায় গৃহস্থের বাড়ী। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ি গ্রামের মেঠো রাস্তায়। শহর ছেড়ে একা একা হারিয়ে যাই আমি গ্রামের রাস্তায়। ওই বুনো ফুলের গন্ধ গায়ে মেখে।
কমছে ঘেঁটুর গান - অভিজিৎ বসু।
মার্চ ১৫, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য গুগল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন