রাত অনেক হয়েছে, ফাঁকা রাস্তায় লোকজন খুব একটা নেই। বাড়ির পাশের ফাঁকা খেলার মাঠে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে বাঁশ, পেরেক, নতুন রং করা কাপড়, মা দুর্গার মুখের চালচিত্র আরও কতো কিছুই। ধীরে ধীরে সেজে উঠছে পাড়ার পুজোর মণ্ডপ বাইরে থেকে আসা কারিগরদের হাতে। পূজোর বাকি যে মাত্র আর কটা দিন। তারপরে সব রাস্তায় নেমে পড়া। পিতৃপক্ষের অবসান হতে আর বেশি দেরি নেই যে। দেবীপক্ষের আগমনীর গান শুনে ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে মনে মনে মার আসার খবরে ভারী সিসের মতো মন এর ভালো হয়ে যাওয়া।
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে ঠিক এই দুর্গা পূজোর সময় আমার খুব শরীর খারাপ হলো। টানা দৌড়ে ছুটে বেড়ানো এক মিডিয়ার অফিসে অফিস করা আমি কেমন যেন অসুস্থ হয়ে গেলাম। আচমকাই থেমে গেলো আমার দৌড় অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে। যদিও আমার এই জীবনের দৌড় তো থেমে গেছে পাঁচ বছর হলো প্রায়। যেদিন চব্বিশ ঘন্টা চ্যানেলের চাকরি ছেড়ে নিজেই ঘোষণা করে টোটো চালকের আসনে আওয়ামী লীগের নেতার মত বসে পড়ে থাকার দিন থেকেই যে আমি দৌড় থামিয়ে দিয়েছি আমার নিজের ইচ্ছায় আর কিছুটা স্বেচ্ছায়। তার জন্য আমার কোনো আফশোষ নেই কিছুই আজ। কারণ কারুর পা ধরে আর তাদের সামনে হাতজোড় করে তো বাঁচতে হচ্ছে না আমায় এই বয়সে, যা এখনকার মিডিয়ার লোকদের বেশিরভাগ সাংবাদিকদের কাছেই দস্তুর হয়ে গেছে সর্বত্রই এটাই রেওয়াজ যে এই আমলে।
তবু পূজো আসছে, পূজো এলে মনটা কেমন যেনো থমকে যায়। মনে হয় পূজোর সেই আনন্দ, উত্তেজনা, অফিস এর তাড়া, পূজোর বোনাস এর টাকা পেয়ে হঠাৎ করেই খুশি হয়ে যাওয়া, মেয়েকে নিয়ে হাত ধরে দোকান ঘুরে নতুন জুতো আর জামা কেনা। রাত করে অফিস থেকে বাড়ী ফিরে ভীড়ের মাঝে মিশে যাওয়া। সব কেমন যেন হারিয়ে গেলো আচমকাই আমার জীবন থেকে কর্পূরের মতো। পূজোর আগের শেষ রবিবার দোকানে ক্রেতার ভীড়, রাস্তায় জনপ্লাবন দেখে কেমন যেনো এই ভীড়ে আবার মিশে যেতে ইচ্ছা হলো আবার। কিন্তু উপায় নেই যে আর তার কোনও।
যাই হোক রাতের বেলায় পাড়ার মণ্ডপে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা মা দুর্গার চালচিত্র, মার শুকনো মুখ দেখে কেমন যেন লাগছে আমার। পূজোর তাল কি তাহলে কেটে গেছে কোনো ভাবে এই বছর নানা ঘটনার অভিঘাতে আর সংঘাতে। কে জানে পূজোর মরশুমে এমন সুর, তাল, লয় কেটে গেলে যে বেশ মুশকিল হয়। দুর থেকে ত্রিপল ঢাকা মণ্ডপের ছবি তুলে ঘরে ফিরলাম আমি রাত দুপুরে একটু মন খারাপ নিয়েই ধীর পায়ে আর ধীর লয়ে।
যে রাত দুপুরে রাত দখল করে অন্দোলন আর জাস্টিস চেয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল গোটা বাংলা। যে রাত দুপুরে তিলোত্তমার মৃত্যু হয়েছিল একদিন। যে রাত দুপুরে বিচার এর দাবিতে উত্তাল হয়ে ছিল গোটা দেশ এমনকি বিদেশও। সেই রাত দুপুরে কেমন থম মারা মুখে মণ্ডপের দেওয়ালে মা দুর্গার চালচিত্র দেখে, মার মুখ দেখে কেমন যেন মন খারাপ হলো আমার। যে রাত দুপুরে সারা রাত ঘুরে ঘুরে আমরা তিনজন আঙ্গু পাঙ্গু আর গাঙ্গু একসাথে সারারাত জেগে ঠাকুর দেখতে যেতাম হাসি মুখে সবাই মিলে এই মণ্ডপ আর ওই মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম আমরা একবুক আনন্দ নিয়ে।
যে রাত দুপুরে এমন একদিন ভি আই পি পাশ নিয়ে বুক ফুলিয়ে বড়ো মাপের পূজো মণ্ডপে ঢুকতাম আমি হাজার হাজার মানুষকে পাশে ফেলে অনায়াসেই কি সুন্দর হাসিমুখে। কেমন বুক ফুলিয়ে ভিআইপির পাশ থেকে যেতো আমার বুকের পকেটে। যে রাত দুপুরে পোদ্দার কোর্টের সেই চব্বিশ ঘন্টা অফিসের এক কোনের গেস্ট রুমে সারারাত ঠাকুর দেখতে এসে পা ব্যথ্যা নিয়ে শুয়ে পড়া তিনজন মিলে একসাথে কাউকে কিছু না জানিয়ে।
কিন্তু সেই সব নিশুতি রাত, দুপুর যেনো আজ থম মেরে গেছে আচমকাই নিজে নিজেই স্বেচ্ছায়। মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ কেমন করে যেন বদলে গেছে চাঁদনী রাতের ছবির মতোই। গভীর রাত আর দুপুর বেলায় সেই চেনা মার অচেনা ছবি তার চালচিত্র কেমন চুপ করে ঝুলে আছে পাড়ার মণ্ডপে রাতের অন্ধকারে পুরোনো দেওয়ালে ঘড়ির কাঁটার মতই স্থির হয়ে। দুর থেকে ক্লাবের তার জালের এই পার থেকে মুঠোফোনে বন্দী মার বিষণ্ন মুখ এর চালচিত্র ও নিষ্প্রভ মার চোখ। কেমন যেনো গাছের পাতার ফাঁক গলে মার ওই মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে।
মা আসছেন - অভিজিৎ বসু।
ত্রিশ সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন