সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ওরা চারজন


ওরা চার জন। এক মনে আপন মনে সংসার পেতেছে।খেলা বাটি খেলায় মগ্ন ওরা। ঘরে ফেরার তাড়া নেই কোনও। স্কুল বন্ধ হবার পরই দৌড়ে এসেছে ছোট্ট মেয়েটি কারণ তিন জন যে অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ ধরে। সংসার সাজিয়ে খেলা বাটি খেলবে বলে। স্কুলের পোশাক পরে গায়ে ঘামের বিন্দু নিয়ে মোনালিসার মত উদয় হয়েছে এই ছোট্ট মেয়েটি।কানের লতিতে ছোট ফুটোয় ঝুলছে সুতো। গলায় একটা সরু আধময়লা হার। হাতে রং চটা ক গাছা চুরি। এত কম সাজে কি সুন্দর দেখায় ওকে। পাথরে খোদাই করা বর্ণমালা যেন ওর মুখে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। 



আর ঠিক তার পাশে মুণ্ডুহীন পুতুলকে বুকে জড়িয়ে একমনে কাজে ব্যস্ত চিনু। খুব মন দিয়ে কাজ বোঝাচ্ছে অন্যদের। ভাঙা প্লাস্টিকের গ্লাসে ঘোলা পানি। যে পানি ওরা পান করে। তাদের গ্রামে পানির যে বড়ো অভাব। লাল মাটির রাস্তায় পড়ে থাকা ইট দিয়ে তৈরী ঘরের চৌকি। গাছের বুনো ফুল আর পাতা দিয়ে সাজানো হয়েছে এই ছোট্ট ঘর। সাজছে মুণ্ডুহীন পুতুল। গাছের পাতা দিয়ে সাজানো হচ্ছে পুতুলকে ঠিক যেন নিজেকে সাজানো বা পাশের সঙ্গীকে সাজানো হচ্ছে বিয়ের সময়। দেখে মনটা কেমন ভরে যায়।

 সত্যিই পথ চলার রাস্তায় এই ছোট্ট খেলনা বাটির জীবন দেখে থমকে গেল আমার পথ চলা। জেলা বীরভূম। গ্রাম পঞ্চয়েত দেউচা। গ্রামের নাম বাহাদুরগঞ্জ। যে দেউচা নিয়ে এত মাতামাতি হৈ চৈ কোনো কিছুই ওরা জানে না। ওরা শুধু জানে ওদের শৈশব বড় ছোট্ট। আদিবাসী শিশুদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত নয় তাদের। কিন্তু নিশ্চিত নয় জেনেও নীরবে খেলনা বাটির জীবন থেকে আনন্দ পায় ওরা একে অপরে। সত্যি জীবনের জলতরঙ্গ বাজানো শিখতে হয় এদের কাছে। জানতেই পারতাম না এইভাবে জীবনের হিসাব নিকাশ করতে হয়। চেটে পুটে খিদে পেটে আনন্দ ভাগ করে খেতে হয় একে অপরের সঙ্গে।

 সত্যি বলছি নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। আমরা শহুরে জীবনে অভ্যস্ত কেতা দূরস্ত ধোপ দুরস্ত মানুষরা কি করলাম কিছুই শিখতে পারলাম না ওদের কাছে। কি অনাবিল সুখের আবেশে ওদের চোখ মুখ চক চক করছে। কালো মেয়ের খুদি দাঁতের হাসি বুক চিরে যায়। বুকের ভেতরের যন্ত্র আমাকে জিজ্ঞাসা করে কি দেখছো অমন করে। আপন মনে খেলা করা চার শিশু কে দেবদূত মনে হয় আমার। ইচ্ছা হয় বলি এই আমায় নিবি তোদের সাথে খেলতে। কিন্তু না জিভ দিয়ে বের হয় না এই শব্দ। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি ওদের দিকে। ওরা শুধু চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে আর মিটি মিটি হাসে। শুধু একটাই অনুভূতির সৃষ্টি হয় আমার নিজের মধ্য ওরা আমাকে নেবে খেলতে। ভরসা পাই না বলতে, কিন্তু না বলা কথা গুলো গলায় আটকে ছিল তা এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। বুকের ভেতরের যন্ত্রটা যা কষ্ট পাচ্ছিল এক নিমেষে সেই কষ্ট উধাও। 

চারটি শিশুর খেলনা বাটির সংসার জীবন আমায় নতুন করে ভাবতে শেখায়। জীবনকে দেখতে শেখায়।মানুষকে দেখতে শেখায়। সত্যিই তো এই ভাবে জীবনের হিসাব নিকাশ করা হয়নি বহুদিন। ধীরে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে ওদের বাড়ি ফেরার তাড়া নেই কোনও আমার আছে তাই ধীর পায়ে লাল মাটির রাস্তায় আস্তে আস্তে শরীরটাকে টেনে নিয়ে ঘরে ফিরি। শুধু ওদের চোখের ঝিলিক আর হাসির উত্তাপ আমার সারা শরীরে ওম হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আমি বলি আবার আসবো আজ যাই রে। বাহাদুর গঞ্জের চার বাহাদুর কে সেলাম জানিয়ে ঘরে ফেরার বাস ধরি আমি।

ওরা চারজন - অভিজিৎ বসু।
চৌদ্দ নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।

মন্তব্যসমূহ

  1. কখনও কখনও লিছু লেখা এই বয়ে নিয়ে চলা জীবনকে থমকে দাঁড় করিয়ে দেয়।বেঁচে থাকা, সুখ, আনন্দর মানে কী তা নিয়ে একটা সমুদ্র সমান প্রশ্ন তুলে দেয়।তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে কে বড় ? ওই বাচ্চাগুলোর মুখে লেগে থাকা শান্তি নাকি অনেক দাম দিয়ে কেনা সুখ।শাবাশ লেখক।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

জামালপুরের প্রদীপ দা

আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় বর্ধমানের জামালপুরের সেই দাপুটে ঠোঁট কাটা সাংবাদিক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এর কথা। সেই বিখ্যাত সুভাষ তালুকদার এর কাগজ সংবাদে মাত্র এক টাকার কাগজে কাজ করা সংবাদ পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক সেই প্রদীপ দা। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বাঁশের ব্যারিকেডের এপারে দূরে দাঁড়িয়েও যে খবর করা যায় সেটা বড়ো মিডিয়ার সাংবাদিকদের হাসি মুখে দেখিয়ে দিয়ে, আর তাদের খবরের ময়দানে গোল দিয়ে শুধু খবরকে ভালোবেসে ছোটো কাগজে কাজ করে চলা সর্বদা হাসি মুখের সেই আমাদের প্রদীপ চ্যাটার্জী দা।  কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে যাওয়া আর এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়া ঝোলা কাঁধে সেই খবরের খোঁজে সেই জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রদীপ দা। সেই বিখ্যাত পন্ডিত রবিশঙ্কর আর উদয়শঙ্কর এর আপন মাসতুত ভাই এর ছেলে সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় দাদা। সেই বামদের আমলে জামালপুরের এলাকায় দাপিয়ে খবর করে ছুটে বেড়ানো সেই প্রদীপ দা। সেই তৃণমূল আমলেও একভাবেই ছুটে বেরিয়ে কাজ করা আমাদের সদা ব্যস্ত প্রদীপ দা।  সেই বাবার অসুস্থতার কারনে বড়ো সংবাদ মাধ্যমে কাজ না করেও...

আমার স্যার কাজীদা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।  কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।  কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ স...

কুড়ি থালা দশ টাকা আর রসিক মুলুর জীবন

নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।  ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।  একে অপ...

শুভ মকর সংক্রান্তি

মকর মানেই নতুন জামা কাক ভোরে স্নান, রাত্রি জেগে মিঠে সুরে টুসুমণির গান। মকর মানেই পিঠে - পুলির গন্ধে ম - ম হাওয়া, ডুলুং পাড়ে টুসুর মেলায় দল বেঁধে যাওয়া। মকর মানেই মোরগ লড়াই পাহুড় জেতার সুখ, সন্ধ্যা - রাতে মাংস পিঠের স্বাদে ভরা মুখ। মকর মানেই হাতি - ঘোড়ার পুজো করম তলে, সান্ধ্য হাওয়ায় মন উদাসী দিমির দিমির বোলে। আসলে আজ এই মকর সংক্রান্তির দিন, টুসু মেলার দিন, টুসু গানে নিজেকে মাতিয়ে দেবার দিন। অজয় এর ধারে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় ভীড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেবার দিন। অজয় এর জলে ডুব দিয়ে স্নান করে পূণ্য অর্জনের দিন। আর নদীর ধারে মোরগ লড়াই এর দিন। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, সুতো লাটাই হাতে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার দিন। কেমন যেনো রাশির একটি স্থান থেকে অন্য রাশিতে স্থান পরিবর্তনের দিন। সূর্যের দেবতাকে সকালে উঠে স্নান সেরে প্রণাম জানিয়ে শক্তি সঞ্চয় এর দিন। সূর্যের উত্তর দিকে চলে যাবার দিন। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাওয়ার দিন।  এই মকর সংক্রান্তি এর ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড় রয়েছে। এটি কৃষি চক্র এবং ফসল কাটার মৌসুমের সাথে জড়িত। এই মকর সংক্রান্তি চ...