আমার পঁয়ত্রিশ বছরের সাংবাদিক জীবনে এর থেকে কঠিন কাজ আমার জীবনে আর কোনোদিন আসেনি। এত ভয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব জড়তা আমায় ঘিরে ধরেনি কিছু লিখতে বসে। খবরের দুনিয়ায় নানা কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছি একসময় তবু সেটাকে সামাল দিতে এত বেগ পেতে হয়নি কোনো সময়।
শুধু এই একটা লেখা লিখতে বসে সেই কঠিন এক পরীক্ষার মুখোমুখি আমি আজ এই রাতদুপুরে। মনে হচ্ছে এর থেকে বোধহয় সেই জুলজি এর সেই ফাইনাল প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার দিন যেদিন লেটা না কি মাছ কাটার জন্য ছুরি আর কাঁচি হাতে নিয়েছিলাম সেইদিন অনেক ভালো ছিল। এত উদ্বেগ টেনশন আর ভয় নিয়ে লিখতে বসতে হয়নি আমায় কোনোদিন। কি যে বিপদে পড়তে হলো আমায় কি বলি। আর স্যার এর বার বার অনুরোধ অভিজিৎ আমার উপন্যাস একটি বার পড়ে দেখো তুমি। আর কেমন লাগলো তার মন্তব্য লিখে দিও তুমি।
আচ্ছা বলুন তো আপনারাই এটা কি স্বাভাবিক ঘটনা। স্যার এর লেখা গোধূলি লগ্নে পড়ে কেমন লাগলো তার জন্য কলম ধরা। এটা আমি একটু এড়িয়েই চলেছি বারবার। নানা লেখার মাঝে এই রঞ্জনা আর অখিলেশ আর বিচ্ছেদের গল্প আমায় বেশ নাড়া দিয়েছে। সত্যিই বলতে কি জানিনা আমি এই গল্প জীবনের গল্প কি না। এই গল্প, তার চরিত্রে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন কি না। কিন্তু লেখকের এই নানা ভাবে শব্দের জাল দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এই জীবনের কাহিনী। যে কাহিনী পড়ে আমি নিজের কলেজ জীবনে ফিরে গেলাম।
মনে পড়ে গেল আমার নিজের জীবনের নানা কথা। সেই কলেজ, সেই গঙ্গার ধার, সেই সুন্দরী রঞ্জনার মিষ্টি মধুর হাসি, সেই আখিলেশ এর কাতর আর্তি ভালোবাসার জন্য। সেই বেরিয়ে পড়া গাড়ি নিয়ে বন্ধু আর বান্ধবীকে নিয়ে। বেশ যেনো অতীত স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া। এই বয়সে এসেও স্যার এখনো স্বপ্ন দেখেন ভালোবাসার। এখনও স্বপ্নে নিজের ভালোবাসার চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর লেখার ছোট্ট ছোট্ট ঘটনায় ফুটিয়ে তোলেন নানা ধরনের গল্পের শব্দের জাল বিছিয়ে। যেখানে তিনি পাঠককে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যান। পাতা উল্টিয়ে পড়তে হয় কি হলো রঞ্জন আর অখিলেশ এর।
জীবনের এই গোধূলি বেলায় এসেও এমন একটি উপন্যাস লেখার সাহস করে বুকে বল নিয়ে এগিয়ে গেছেন তিনি এটাই আমায় অবাক করে। আমি তো ব্লগ লেখা লিখে বেড়াই। জীবনের নানা চরিত্রকে তুলে ধরি। আমার সাদা জীবনের কালো কথায়। সেখানে স্যার এর এই উপন্যাস নিয়ে কি লিখবো আমি সেটা ভেবেই দিনরাত এক করেছি আমি। যিনি আমায় বিনে পয়সায় পড়িয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে সাহায্য করেছেন তাঁর লেখার জন্য আমি কলম ধরবো। এত বড় ধৃষ্টতা আমার নেই।
তবু বারবার স্যার এর আবেদন অভিজিৎ একটু দেখো তুমি। তোমায় আমি পাঠিয়ে দিয়েছি আমার লেখা। ধীরে সুস্থে পড়লাম এতদিনে শেষ করলাম। মনে হলো কঠিন পরীক্ষা হলেও সেই পরীক্ষায় আমায় বসতেই হবে ছুরি আর কাঁচি নিয়ে। না হলে যে হেরে যাবো আমি। স্যারকে কি বলবো আমি স্যার পারলাম না কিছুই লিখতে। তাই গল্পে নায়িকার প্রবেশ ঘটেছে বেশ দ্রুত। দুজনের আলাপ পর্ব পরিচয় বড্ড তাড়াতাড়ি হয়েছে।
কিন্তু এরপর থেকে বেশ আপন ছন্দে রচিত হয়েছে এই দুজনের রঞ্জনা আর অখিলেশ এর এই কাহিনী। যে কাহিনী আমায় শেষ অবধি আটকে রেখেছে। শেষ পাতা পর্যন্ত উল্টিয়ে দেখে মনে হলো মিলন আর বিরহ এই নিয়েই তো আমাদের জীবন। যে জীবনে এই দুই এর মাঝে আর কিছুই নেই। লেখক বিরহকে বেছে নিয়েছেন তাঁর লেখায়। জানিনা হয়তো তাঁর এই জীবনের উপন্যাসে বিরহ মিলনকে হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেছে। তাই শেষ পর্যন্ত অখিলেশ বিদেশ যাওয়া ছেড়ে যখন রঞ্জনার জন্য দেশে রয়ে গেলেন তখন রঞ্জনা অখিলেশ কে ছেড়ে চলে যাবার দিন গুনছে।
বিশ্বাস করুন স্যার, জানিনা কেনো এই শেষ পর্বে এসে আমি নিজেও কেমন আনমনা হয়ে পড়লাম এই লেখা পড়ে। ফিরে গেলাম আপনার এই বাড়ীর সেই ওপর তলার ঘরে পড়তে আসতাম আমরা সবাই। পড়া শেষ করে ফিরে যেতাম বাড়ীতে। হাসি ঠাট্টা আর জীবনের নানা স্বপ্ন দেখতে দেখতে পড়া শেষ করলাম।
যা ভেবেছিলাম আর স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই দিন সব হয়তো সত্যি হয়নি সেদিন। জীবনে মিলনের সুতোয় মালা গাঁথা হয়নি হয়তো আমাদেরও। হয়তো বিরহকেই আলিঙ্গন করতে হয়েছে কিছুটা বাধ্য হয়েই। তবু কেমন যেনো ছন্নছাড়া জীবন নিয়েই কেটে গেলো এই গোটা একটা জীবন। তবু গোধূলি লগ্নে এসে আপনার এই লেখা পড়ে, এই উপন্যাস অনেকটাই আমায় সেই আমার পুরোনো কলেজের দিনে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। মনে হলো রঞ্জনা, অখিলেশ সব যে বড়ো চেনা চরিত্র এরা আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আজও। যেখানে অখিলেশ রঞ্জনাকে হারিয়ে আজও গুমড়ে মরে রাতের অন্ধকারে।
স্যার এর লেখা গোধূলি লগ্নে - অভিজিৎ বসু।
ত্রিশ নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন