সকাল বেলায় সূর্যের নরম আলোয় মনটা ভরে গেলো আমার। ট্রেনের কামরায় বসে অনুভব করলাম আমি এই আদিগন্ত চরাচরে ছড়িয়ে পড়ছে নরম লাল সূর্যের মিঠে রোদের আভা। দূরের মাঠ থেকে গাছের ফাঁক দিয়ে গলে গলে পড়ছে মিস্টি রোদের নরম আলো। যে আলোর দিকে তাকিয়ে দেখি আর আমার বিধুর মনটা বড় ভালো হয়ে যায়। ভাবি সত্যিই কি অদ্ভুত করে সৃষ্টি করেছেন বিধাতা এই সুন্দর বিশ্বকে।
কুয়াশা মাখা মাঠ ঘাট পেরিয়ে, সাদা হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে চুপ করে বসে থাকি আমি সাদা চাদর জড়িয়ে। দুলকি চালে চলতে থাকে আমার ট্রেন। আমি বসে বসে দুলি, আর এগিয়ে যাই। সাপের মতো হেলে দুলে ট্রেন এগিয়ে চলে ধীরে ধীরে কুয়াশার রাস্তা ভেদ করে। বাড়তে থাকে ট্রেনের গতি। আমি দেখি বছরের শেষের দিনের সকালে এই সকালে ঘুম থেকে না উঠলে তো, এই প্রকৃতির এত সুন্দর রূপ দর্শন হতো না আমার ট্রেনের জানালার ভেজা কাচ এর ওপর শিশির এর ঝাপসা দাগ দেখি। মাঝে মাঝে দরজার ফাঁক গলে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগে আমার মুখে। আমি উপভোগ করি সেই ভোরের ঠাণ্ডাকে। ট্রেনের দুলকি চালের চলা বেশ ভালই লাগছে আমার। কিন্তু ওর তবু একটা গন্তব্য আছে, তাড়া আছে, আমার যে কিছুই নেই এই জীবনে।
বছর শেষের এই বিশেষ দিনে পথে বেরিয়ে পড়েছেন অনেকেই। মনে পড়লো আমার সেই ছোটো বেলায় এমন বছরের শেষের দিনে ভোরবেলায় উঠে গেছিলাম আমরা সেই মল্লিকপুরে পিকনিক করতে। কি উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম সেই দিনে। কত স্মৃতি, কত মধুর সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম সেই সময় ছোটো বয়সে। কত অল্প কিছু পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হতাম আমি। আজ এই বয়সে এসে সে সব ভেবে বেশ আনন্দ পাই মনে মনে। সেই যে ছাদে উঠে এই এমন শীতের সময় পিকনিক করা হয়েছিল। কালো বড়ো লোহার কড়াইতে, আলুর দম হয়েছিল। শাল পাতায় কাঠি দিয়ে সেই ঝাল আলুর দম খেয়ে অদ্ভুত স্বাদে অতুলনীয় লেগেছিল সেই দিন। কই সেই ছোটো বেলার সেই ঝাল আলুর দমের স্বাদ তো আর পেলাম না আমি কোনো ভাবেই আর এই জীবনে।
সত্যিই তো পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে স্মৃতির উত্তাপ অনুভব করে বেঁচে থাকার মধ্যে একটা অনাবিল আনন্দ আছে। যাকে বোধহয় ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না কিছুতেই। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মনে হয় যদি আমরা আবার ফিরে যেতে পারতাম অন্ততঃ একটা বারের জন্য সেই পুরোনো ফেলে আসা জীবনে। তাহলে কি ভালোই না লাগতো বলুন। জানি জীবনের সব চাওয়া আর পাওয়া যায় না। তবু ইচ্ছা করে সেই ভালোবাসার স্পর্শ ভরা জীবনটাকে একবারের জন্যেও ফিরে পেতে। একটু ছুঁয়ে দেখতে।
বছর শেষের পথে এসে তাই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হয় আমার এই এলোমেলো এলেবেলে বিন্দাস জীবনকে। কমে যাওয়া জীবনের একটা বছরকে বিদায় জানাতে আমার মন চায় না কিছুতেই। মনে হয় আমার তাহলে তো এটাও পুরোনো ফেলে আসা দিনের আলোয় গোপনে লুকিয়ে যাবে অতীত ইতিহাস এর পাতায় ধীরে ধীরে। যাকে আমি হারাতে চাই না কোনোদিনই। অতীত হতে দিতে চাই না তাকে কিছুতেই কোনওভাবেই।
দ্রুত গতিতে হুইসেল বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। আমিও এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে। অতীতকে ভুলে, অতীতকে ছেড়ে, পিছনে ফেলে সামনের দিকে । জানলা দিয়ে দেখি চোখের সামনে লাল সূর্যটাও কেমন সমান তালে এগিয়ে চলেছে ট্রেন এর গতির সাথে তাল মিলিয়ে। আজ রাত পোহালেই শেষ ২০২৪। আগামীকাল সকাল বেলায় ২০২৫ এর নতুন ভোর। নতুন আশা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার ভোর। নতুন করে পরিকল্পনা করে একটু স্বপ্ন দেখে বাঁচার মিষ্টি ভোর। জীবনের ক্যালেন্ডারে আর দু হাজার চব্বিশ নেই। চলে এলো দু হাজার পঁচিশ। যে নতুন বছরে সকাল হলেই আনন্দের সাথেই সবার সাথেই বলে ওঠা হ্যাপি নিউ ইয়ার।
বছর শেষের দিনের ভোর - অভিজিৎ বসু।
একত্রিশ ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক ও নিজের মোবাইল ফোনে তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন