শীত পড়লেই ওরা আসে। একদম সাজিয়ে গুজিয়ে। আলো জ্বেলে তাঁবু খাটিয়ে ওদের উপস্থিতি টের পাই আমরা। ছোটবেলায় এই তাঁবু ফেললেই বুঝে যেতাম সার্কাস এসে গেছে। জীবজন্তু আর কিছু মানুষের বাহারি খেলার নানা আয়োজন। ঠাণ্ডা হিমের পরশ। মাইকে কেমন উত্তাল তরঙ্গ ব্যবহার করা মিউজিক। বুকের মাঝে দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজ। দড়ি ধরে এদিক থেকে ওদিকে ছুটোছুটি,লাফালাফি আর বুকের মাঝে ধড়াস ধড়াস আওয়াজ। পারবে তো, পড়ে যাবে না তো যদিও নিচে জাল আছে। বেঁচে যাবে।
সার্কাস এর খেলা দেখতে গেছিলাম শ্রীরামপুরে সেই বিখ্যাত স্টেডিয়াম এর মাঠে। ছোটো বয়সে। বেশ সামনে বসে বাঘ সিংহের খেলা দেখার মজাই আলাদা। সেই আগুন এর মধ্যে ঝাঁপ দেওয়া। রিং মাস্টার এর নির্দেশে বন্য জন্তুর কথা শুনে খেলা দেখানো। একটা কেমন তিন ঘণ্টার শো কিন্তু সেই মজার জগৎ এ পৌঁছে যাওয়া। যে জগতের মাঝে কত কিছুই যে মশলা পাওয়া যেতো তার ঠিকানা নেই।
সেই ছোট্টো সাদা ফর্সা নরম মেয়েটির টানা টানা কাজল কালো চোখ আঁকা। কেমন সে এই দড়ি থেকে ওই দড়িতে লাফিয়ে চলে যাওয়া তার অনায়াসে নিশ্চিন্তে আর হাসি মুখে। আমার বুকের মাঝে হাজার হাতুড়ির বাড়ি এই ওর কিছু হবে না তো। ঢং ঢং করে ঘণ্টার আওয়াজ। শো শেষ। লাইন দিয়ে ওদের গ্রীন রুমে ফিরে যাওয়া। যাওয়ার পথে ঘাড় ঘুরিয়ে মিষ্টি হাসি ওই ছোট্ট ফর্সা মেয়ের। ওর চুলের বিনুনির দোলা, চোখের তারায় আলোর ঝিকিমিকি, ওর কচি হাতে দড়ির দাগ, আজও মনে পড়ে যায় আমার এই বুড়ো বয়সেও।
তারপর যতবার সার্কাস দেখতে গেছি আমি বহুবার ওকে খুঁজেছি আমি বড়ো হয়েও। সেই ছোট্ট বিনুনি বাঁধা মেয়েটিকে। না, আর পাইনি তাকে কোথাও। হয়তো হারিয়ে গেছে কোথাও। হয়তো সেই দড়ি ধরে লাফ মারার খেলা ছেড়ে দিয়েছে সে। ঘর বেঁধেছে সে কোথাও। শীত পড়লে আর তাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হয় না আর।
তবু আমার সেই ছোটবেলার সেই ছোট্ট মেয়েটির কথা খুব মনে পড়ে যে। ওই ছোটো বয়সেও কেমন করে যেন শিখে গেছিলো সে ওই দড়ি ধরে ঝাঁপ দিয়ে খেলা দেখানোর কথা। যা সে রপ্ত করেছিল খুব ছোট বয়সেই। হাসতে হাসতে সবাইকে অবাক করে ও কেমন করে যে এই দড়ি আর ওই দড়ি ধরে ঝাঁপ মেরে, মরতে মরতেও বেঁচে যেত সেটাই বড়ো আশ্চর্যের বিষয়।
আসলে গোটা জীবনটাই তো একটা সার্কাস। যে সার্কাস এর মাঠে খেলতে নেমে কেউ আমরা হাবুডুবু খাই। কেউ দড়ি ধরে ঝাঁপ মারতে গিয়ে কোমর ভেঙে মাটিতে পড়ে হা হুতাশ করি। আবার কেউ কেমন স্বচ্ছন্দে এই দড়ি ধরে ওই দড়িতে লাফ দিয়ে বাহবা কুড়িয়ে হাততালি পাই। গর্বে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বুক ফুলে ওঠে সমাজে, সংসারে, বন্ধুদের কাছে, অফিসে সর্বত্রই। শুধুই জেতার আনন্দ আর জয়ের আনন্দ। চারিদিকে বাজে শুধুই দ্রিমি দ্রিমি ড্রাম এর আওয়াজ। রিং মাস্টার এর সামনে মাথা নত করে গলায় মেডেল পড়ে গর্বের সঙ্গে মঞ্চ ত্যাগ করি।
সত্যিই তো জীবনের এই সার্কাস দেখতে বেশ ভালই লাগে আমার। খবর পেলাম বোলপুরের মাঠেও সার্কাস এর তাঁবু পড়েছে। সন্ধ্যায় সাইকেল চালিয়ে চলে গেলাম জানতে কি টিকিট এর দাম আর কটায় হচ্ছে শো। একশো, দেড়শো, দুশো আর তিনশো টাকা দিয়ে দেখতে হবে সার্কাস। একটা, চারটে আর সন্ধ্যা সাতটার শো। দাম শুনে পিছিয়ে এলাম। পাঁচ টাকা দেখার সার্কাস আজ একশো টাকা, দুশো টাকায় তিনশো টাকায় দাম উঠেছে তার।
ভীড় উপচে পড়ছে মাঠে এমনটা নয়। বেশ ফাঁকা চারিদিক। গিজগিজ করছে ভীড় তাও নয়। সেই আলো জ্বলা তাঁবু, সেই মন কেমন করা মিউজিক, সেই ঠাণ্ডা হিমেল মাঠের পরশ, সেই দড়ি ঝুলছে মঞ্চের এদিক থেকে ওদিক। আমি একটু দেখার চেষ্টা করলাম ফাঁক ফোঁকর দিয়ে যদি কিছু দেখা যায়। না পেলাম না কিছুই দেখতে। বিফল মনে মাঠ ছাড়লাম আমি।
আর যার জন্য এলাম আমি সেই ছোট্ট মেয়েটির টানে ঘর ছেড়ে, না সেতো কবেই হারিয়ে গেছে আমার এই সার্কাস এর জীবন থেকে। আমাদের সবাইকে হারিয়ে দিয়ে। সেতো অনেক আগেই শিখে গেছিলো কি করে জীবনের সার্কাস এর মঞ্চে এই দড়ি ছেড়ে অন্য দড়ি ধরে, কি করে মরতে মরতেও হাসি মুখে বেঁচে থাকতে হয়। কি করে জীবন আর মরনকে বাজি রেখে দিয়ে সেই ছোটোবেলায় খেলা বাটি খেলার দিনেও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে হয়। আর হাসতে হাসতে ট্রাপিজ বারের ওপর দিয়ে আগুন জ্বলা রিং এর ভিতর দিয়ে মাথা গলিয়ে হাসি মুখে টপকে চলে যেতে হয়। আর তারপর অবহেলায় হাততালি কুড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলতে হয় দুর এসব তো নস্যি আমার কাছে।
সত্যিই বিশ্বাস করুন আমি আজও এই বুড়ো বয়সে খুঁজে ফিরি ওই ছোট্ট মেয়েটিকে। যে অল্প বয়সে কেমন অনায়াসে নিশ্চিন্তে হাসি মুখে জীবনের সার্কাস এর মাঠে খেলতে নেমে ভয় পায়নি একদম। ঘাবড়ে যায়নি একদম। পেছন থেকে কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেও পড়ে যায়নি সে। নিজের আত্মবিশ্বাস, জেদ, কঠিন কঠোর পরিশ্রম আর নিষ্ঠা মেনে এগিয়ে চলেছে নিজের লক্ষ্যে। আর জীবনের ওই ছোটো বয়সেও কেমন বাহবা দিয়েছে, হাততালি দিয়েছে। আর সে সবার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দুহাতে বাহবা কুড়িয়ে মঞ্চ ছেড়েছে হাসি মুখে।
আজ এই সার্কাস এর মাঠ থেকে বের হয়ে আমিও কেমন যেনো থমকে দাঁড়ালাম রাস্তার পাশে। মাথার ওপর ঠাণ্ডা কালো আকাশ। একটা দুটো তারা দূরে চুপ করে আমায় দেখছে তারা। আর মিটিমিটি হাসছে দুর থেকে। আর ভাবছে সত্যিই কি বোকা আমি। যে এই বুড়ো বয়সেও, সেই দড়ি ধরে ঝাঁপ দিতে পারি না আমি জীবনকে বাজি রেখে হাসতে হাসতে। ওই ছোটো মেয়েটিকে দেখেও কেনো যে আমার ভয় কাটলো না এতদিনেও কে জানে। জীবনের সার্কাস এর মাঠে আমি এক পরাজিত সৈনিক হয়েই বেঁচে রইলাম ওই ছোট্ট মেয়েটির কাছে।
জীবনটাই সার্কাস - অভিজিৎ বসু।
বাইশে নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য নিজের মোবাইল ফোন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন