কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা বোধহয় জীবনকে এক ভাবে গড়ে তোলার কথা ভাবেন। আর অন্য ভাবে তাঁরা জীবনকে গড়ে তোলেন। আসলে এইসব মানুষগুলো বোধহয় শুধুই নিজের কথা ভেবে বেঁচে আর বেড়ে ওঠেন না। শুধুই আত্মস্বার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন না। তাঁরা মনে করেন নিজের জন্যে তো শুধুই বাঁচা নয়। মানুষের জন্যে, জল, জঙ্গল,নদী, জঙ্গলের সহজ সরল আদিবাসী মানুষদের জন্য, তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করা আর বাঁচা। আর সেটাই তো জীবনের আসল উদ্দেশ্য।
আর সেটাকে মাথায় রেখেই তো তাঁর সেই আই এ এস হবার পরও কেমন সেই দেরাদুনে ট্রেনিং পিরিয়ডের সময়ে। হঠাৎ করেই সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সুখের নিশ্চিত জীবন ছেড়ে দিয়ে অজানা এক জীবনে ভেসে পড়া। নিজের জন্যে নয় প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠো মানুষ গুলোর জন্য। সরকারের গোলামি করে তো আর, চাকরি করে তো আর সেই কাজ করা যাবে না কিছুতেই। তাই চাই আন্দোলন। জোরদার একটা আন্দোলন। যে আন্দোলন নাড়িয়ে দেবে সরকারের ভিত। আর তাতেই হাসি ফুটবে গরীব খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের মুখে। যে সহজ সরল হাসি বড়ই সুন্দর।
আর তাই শুধু তিনি একা নন উনিশ জন আই এ এস তাঁদের ট্রেনিং পিরিয়ডে আই এ এস ডিগ্রি ত্যাগ করে এই নকশালপন্থী আন্দোলনে যোগ দেন সেই সময়। সরকারের অফিসার হয়ে সরকারের কাজ করে কি করে মানুষের বিরুদ্ধে হয়ে কাজ করবেন তাঁরা। যদিও পরে বেশ কয়েকজন ফিরে যান পুরোনো কাজে আই এ এস এর কাজে যোগদান করেন তাঁরা। কিন্তু বেশ কয়েকজন প্রায় সাত আট জন নকশাল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সালটা ১৯৬৯ সাল হবে সেই সময়। সেই বিখ্যাত সত্তর এর দশক। তাদের মধ্যে ছিলেন একদম সেই প্রথম আমলের নকশাল নেতা সুবোধ মিত্র। যিনি আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায়। আজ আমার এই আঁকিবুঁকি ব্লগে কালো অক্ষরে। সেই চারু মজুমদার আর কানু সান্যাল এর ঘনিষ্ট নকশাল নেতা সুবোধ মিত্র। একদম গ্রামের মেঠো রাস্তায় সহজ সরল মানুষদের ডাকে চলে এসেছেন তিনি এই প্রায় আশি বছর বয়সে এই প্রান্তিক এর কাছের পারুলডাঙা গ্রামে।
সত্যিই কি অসাধারন এই তাঁর জীবন দর্শন। যিনি সারাজীবন ধরেই তো এই জল, জঙ্গল, নদী আর আদিবাসীদের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তিনি কোনোও হিসেব নিকেশ না করেই। হাজার শরীর খারাপ থাক অসুস্থ হয়েও বেরিয়ে পড়েছেন এদিক থেকে ওদিক হাসি মুখেই। কখনও বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি করেছেন দলের গোপন সংগঠন। কখনও বিহার এর রুখু সুখু এলাকায় দাপিয়ে কাজ করেছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যে একা একা শুধু মাত্র মানুষের কথা আর তাঁদের অধিকার এর দাবিকে আদায় করতে বদ্ধপরিকর হয়ে। হোকনা সেই দাবি আদায় বন্দুকের নলের মাধ্যমেই, ক্ষতি কি তাতে আর কি এমন। গরীব মানুষের দাবি আদায় তো হোক আগে। গরীব মানুষের মুখে আগে হাসি ফুটুক তো। তারপর দেখা যাবে কি করে হলো এই দাবি আদায়।
জীবনের এই দৌড় আর দিন যাপন ধীরে ধীরে তাঁকে পরিচিতি দিয়েছে সারা দেশ জুড়েই। আজ বয়স বেড়েছে তাঁর অনেক। মাঝে মাঝেই মনে হয় এই যে এত আন্দোলন, ছুটে চলা, সব কি দাবি আদায় করা গেলো এই এক জীবনে। যে কাজ করবেন বলে সেই আই এ এস এর কাজে যোগ দিলেন না তিনি একদিন সেই যুবক হয়ে। নাকি কিছুটা ভুল হলো কে জানে। তবু তো আজও কেমন এই আশি বছর বয়সেও স্বপ্ন দেখেন গ্রামের মেঠো মানুষগুলোর জন্য আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে। তিনি যে স্বপ্ন দেখতে বড়ই ভালোবাসেন বরাবর। আর তাই এই বয়সেও বেরিয়ে পড়েন তিনি সেই যুবা কালের মতই হাসি মূখে।
কথা হচ্ছিল আমার সুবোধদার সাথে পারুলডাঙার মাঠে দাঁড়িয়ে। মাঠের একধারে ভীড় জমেছে কিছু গ্রামের প্রান্তিক মানুষের। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাদের গ্রামে একটি শিশুদের জন্য পার্ক তৈরি করে দিতে এগিয়ে এসেছে। আর সেই পার্কের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখা হলো আমার সাথে সুবোধ মিত্রর বহুদিন পরে, বহুবছর পরে। আমায় দেখেই একগাল হেসে বললেন এই তো ২৪ ঘণ্টার অভিজিৎ এসে গেছে। আমি হেসে বললাম না, আমি আর এখন ২৪ ঘণ্টায় নেই দাদা।
আমার মনে পড়ে গেলো সেই বহুদিন আগের কথা। সেই আদিবাসীদের নিয়ে একটি আন্দোলনে হঠাৎ করেই নকশাল নেতা সুবোধ মিত্রের ফোন ইন নিয়ে ছিলাম আমি ২৪ ঘন্টা চ্যানেলে সেই সময়। সেই কথা আজও মনে রেখেছেন তিনি। আর সেই থেকেই এই আমাদের দুজনের যোগাযোগ শুরু। যে যোগাযোগ করে দিয়েছিলেন আমায় তাঁর নম্বর দিয়েছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক হুগলী জেলার কোন্নগরের সেই রূপম চট্টোপাধ্যায়। আমার রূপম দা।
কত কথাই না মনে পড়ে গেলো আমার সেই ওনার কথা লিখতে বসে। বল্লভপুরের বাড়ীর পাশে স্কুল এর ছবি দিলেন আমায় বললেন এখানে এসো একদিন তুমি। সেই হঠাৎ শুনলাম অসুস্থ হয়েছেন তিনি একদিন ছবিতে দেখলাম।। পরে একদিন ফোন করলাম বললেন একটু ভালো আছি ভাই মাঝে খুব শরীর খারাপ হয়েছিল আমার। সেই কত স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে আমার মনে কে জানে। মাঝে মাঝেই ফোন করে ফেলি আমি তাঁকে। এই সেদিন কথা হলো ওনার সাথে, বললেন আমি বল্লভপুর থেকে নাচনসা গ্রামে চলে এসেছি এসো একদিন তুমি অভিজিৎ আমার বাড়ি ভালো লাগবে। আমি বললাম হ্যাঁ, যাবো দাদা একদিন।
সত্যিই অসাধারণ এই জীবন। একটা মানুষ শুধু নিজে নন আরও লোকজনকে মোটিভেট করে আই এ এস এর ট্রেনিং এর সময়ে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলেন জীবনকে একটু অন্য ভাবে দেখতে হবে। জীবনকে সবার জন্য বিলিয়ে দিতে হবে। জীবনকে উপলব্ধি করতে হবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সুখে হেসে খেলে লালবাতি গাড়ী চেপে নয়। একদম ছকে বাঁধা জীবন ধরে এগিয়ে চলা নয় তাঁর। আর তাঁর যেমন ভাবা তেমন কাজ। সত্যিই ভাবা যায় এমন ভাবনার একজন মানুষের কথা।
সেই আমলে ১৯৭০ সালে বীরভূমে সর্বত্রই তখন নকশালদের দাপটে টেকা দায় গোটা জেলায়। যে কোনো রাজনীতির লোকদের তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। রোজ খুনোখুনি লেগেই আছে। সেই সময় থেকেই বীরভূমের দায়িত্বে ছিলেন এই প্রবীন নকশাল নেতা সুবোধ মিত্র। আর বর্ধমানের জেলার দিক দেখতেন কিষাণ দা। যিনি ভাগলপুর জেলে ছিলেন প্রায় ১১ বছর। পরে তিনি মারা যান। আর বীরভূমের দায়িত্বে সুবোধ দা ছাড়াও যাঁরা বিভিন্ন নকশাল নেতা এই বোলপুরের এলাকায় কাজ করতেন তাঁরা হলেন শৈলেন মিশ্র, ভারতজ্যোতি, সুজিত চট্টরাজ, নীরেন ঘোষ এরা কাজ করতেন বীরভূমের বিভিন্ন জায়গায় নকশাল মুভমেন্টে।
যে বীরভূমের সুরুলে এর প্রত্যন্ত গ্রামে সেই সময় রাজ্যে প্রথম আন্ডার গ্রাউন্ড রেডিও স্টেশন তৈরি করা হয়েছিল যাতে সব গোপন খবর আদানপ্রদান করা যায় সেই মাধ্যমে। যা এই এলাকার নকশালরা করে। সেই সময় বারবার কংগ্রেসের বিভিন্ন ছাত্র ফ্রন্টের নেতাদের ওপর আক্রমণ করেছে এই দাপুটে এলাকার নকশাল নেতারা। যে কোনো ভাবেই সেই সব ছাত্র ফ্রন্টের কংগ্রেসের নেতারা কোনও সময় হোস্টেল থেকে, বাড়ী থেকে, পালিয়ে বেঁচেছেন কোনরকমে। যাঁর মধ্যে একজন হলেন সেই আমলের কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদের বড়ো নেতা অশোক মুখোপাধ্যায়। যিনি এখনও এই কথা বলেন গল্প করতে করতে হাসতে হাসতে নিজের ঘরে বসে। সেই ইন্দিরা গান্ধীর ছবি আজও তাঁর ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে। সেই আমলের নবীন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁকে পছন্দ করতেন খুব, সেই গল্প অন্য একদিন লিখবো।
আসলে সেই দিন বদলের স্বপ্ন দেখা এই সময়, এই কালটি বেশ কঠিন সময় পার করেছে এই বাংলার রাজনীতিতে। যে রাজনীতিতে বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস। এটা ছাড়া আর কিছুই যে তাঁদের কাছে ছিল না তখন। আর সেই বিখ্যাত উক্তিকে স্মরণ করেই তো এতগুলো বছর জীবনের কাটিয়ে দেওয়া আর শুধুই দৌড়ে বেড়ানো। এই বীরভূমের নকশাল আন্দোলন নিয়ে বইও আছে অগ্নি সামন্তর। মুলুকের নকশাল আন্দোলন এর ঘটনা নিয়েও লেখা হয়েছে। সম্প্রতি লেখক রূপম চট্টোপাধ্যায় তাঁর বইতে মুলুক এর ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। সেই সুবোধ মিত্র যিনি পড়ে সম্ভবত Communist Organisation of India (Marxist–Leninist)। COI (ML) তৈরি করেন।
ভারতের কমিউনিস্ট সংগঠন (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) ছিল ভারতের একটি রাজনৈতিক সংগঠন। সিওআই (এমএল) গঠিত হয়েছিল মে ১৯৮৫ সালে ছয়টি ভিন্ন গোষ্ঠীর একীকরণের মাধ্যমে। কানু সান্যাল সিওআই (এমএল) এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।সিওআই (এমএল) নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০০৩ সালে সিওআই (এমএল) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) ইউনিটি ইনিশিয়েটিভের সাথে একীভূত হয়ে একটি ইউনিফাইড সিপিআই (এমএল) গঠন করে।
সেই বিখ্যাত মানুষটিকে এই আমার এলোমেলো এলেবেলে বিন্দাস জীবনে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেয়ে বড়ো ভালো লাগলো আমার। যিনি আজও সেই আদিবাসীদের ডাকে বেরিয়ে পড়েন ঘর ছেড়ে মাঝে মাঝেই। সেই চেনা পথ ধরে হেঁটে বেড়ান একা একা। আদিবাসীদের জঙ্গলের অধিকার নিয়ে, এই দ্রুত হারিয়ে যাওয়া খোয়াই নিয়ে, নষ্ট হয়ে যাওয়া কোপাই নিয়ে, মনে মনে ভাবেন আবার আন্দোলনে নামার কথা এই এতো বছর পরেও এতদিন পরেও।
তাঁর বুকের ভিতরটা কেমন যেনো মোচড় দিয়ে ওঠে। তিনি ভাবেন একটা জনস্বার্থ মামলা করলে কেমন হয়। তাহলে যদি এই জঙ্গলকে একটু বাঁচানো যায়। এই নদীকে একটু বাঁচানো যায়। একদিন এই মানুষ গুলোর একটু মুখে হাসি ফোটানো যায়। জীবন মানেই শুধুই মুনাফা অর্জন করা নয়। শুধুই টাকা আয় করে ব্যাংক ব্যালেন্স করা নয়। জীবনের অর্থ তো শুধুই মুনাফা লাভ করা নয়। আরও অনেক কাজ বাকি আছে যে এই একটা ছোট্টো জীবনে।
তাই পারুলডাঙার মাঠে দাঁড়িয়ে ঘুরতে ঘুরতে তিনি যেনো স্মৃতি চারণ করে ফিরে গেলেন সেই সত্তরের আগুন ঝরা দশকে। সেই মানুষটি সত্তরের দশকের মতই আবার একটি বারের মত আন্দোলনে নেমে পড়তে চান। যে বন্দুকের আন্দোলন এই গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের জন্যই। ভালো থাকবেন আপনি সুবোধ দা। সুস্থ থাকুন। আনন্দে থাকুন।
নকশাল নেতা সুবোধ মিত্র - অভিজিৎ বসু।
তেইশ জানুয়ারী দু হাজার চব্বিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন