কিন্তু গ্রামের একটা মাতাল করা মিঠে কড়া স্বাদের গন্ধ আছে। যে গন্ধ তার গায়ে যেনো সেঁটেই থাকে। ঠিক যেনো হলুদ সবুজ সর্ষে ক্ষেতের মাথায় গুনগুন করে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতির মতোই। ঠিক যেনো ভেঙে পড়া দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘুঁটের মতই। যার গায়ে গুবড়ে পোকা ঘুরে বেড়ায় আপনমনে তার নিজের মতো করেই।
বোলপুর থেকে কম বেশী দশ কিলোমিটার রাস্তা হবে এই মহিষঢাল গ্রাম। সবুজ বিপ্লবের মতোই উন্নয়নের কালো মসৃণ পিচ রাস্তা ধরে কেমন গড়গড় করে সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে যাওয়া নিজের ছন্দে। সেই চেনা পথ ধরে, চেনা রাস্তার বাঁক ধরে। সেই পূর্বপল্লীর মাঠ, সেই বিশ্বভারতীর ফার্স্ট গেট, সেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সূবর্ণরেখা বই এর দোকান, সেই রতন কুঠির গেট, সেই শ্যামবাটি বাজার পার হয়ে একেবারে সোজা ক্যানেলের ধার। আর সেখান থেকেই এগিয়ে চলা প্রান্তিক স্টেশনের দিকে। একটু এগিয়েই সায়র বীথি পার্ক এর দিকে এগিয়ে যাওয়া সাইকেল করে। যে পথ ধরে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে কত নাম জানা বিখ্যাত সব হোম স্টে আর রিসর্ট এর জঙ্গল। রাস্তার ধারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা প্রতীক্ষায় আর অপেক্ষায়।
আর এই পথেই হঠাৎ করে সর্ষে ক্ষেতের মাঝে নিজে নেমে পড়ে একটু ছবি তুলে ফেললাম আমি। চারিদিকে বিশাল বাড়ির পাশে সর্ষে ক্ষেতের হাতছানি আমাকেও কেমন স্থবির করে দিলো যেনো। সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়লাম ক্ষেতের মাঝে। মুঠো ফোনে নিজের ছবি তুললাম আমি। জানি এটা দেখে বউ আর মেয়ে গালাগাল দেবেই নিশ্চয়ই। কারণ অকেজো লোকের এই ছবি বন্দী জীবন আর কেই বা মেনে নেয় বলুন। এই কর্মহীন জীবনের মানুষকে কে আর দীর্ঘদিন রেয়াত করে সহ্য করে। তবু তো লোভ সামলাতে পারলাম না আমি। দূরে মেঘের মাঝে সুয্যি মামার আড়াল আবডাল থেকে আমাকে লক্ষ্য করে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকা আর একদৃষ্টিতে আমায় জরিপ করা। আর মনে মনে বলা বুঝলাম কেনো তোমার এই অবস্থা। কাজ নেই, কম্ম নেই, আয় নেই, পয় নেই, খালি এদিক ওদিক দিশাহীন ভাবে বেরিয়ে পড়া আর ঘুরে বেড়ানো। এই এলোমেলো, এলেবেলে, বিন্দাস জীবন নিয়ে।
যাই হোক এই দীর্ঘ পথেই এগিয়ে যেতে যেতে আমার পুরোনো বদরোগ বা অভ্যাস মতই অনেককে ফোন করলাম আমি। দেশের নায়ক নেতাজীর জন্মদিনে হয়তো ব্যস্ত সবাই। তাই কেউ আর আমার ফোন ধরলো না। কিন্তু আমি ভাবলাম সত্যিই কি তাহলে আমি এই সমাজে, এই সংসারে, এই নানা সম্পর্কের বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি, একদম একা একাই ওই সৌরজগতে ঘুরপাক খাওয়া গ্রহের মতোই।
সত্যিই অসাধারণ তো তাহলে এই একা জীবন। মাতৃহীন, বন্ধুহীন, আত্মীয় স্বজনহীন, এই জীবনে কারুর সাথে একটু কথাও বলতে পারবো না আমি। এতটাই আমি একা, একদম একাই। না, মন সায় দিলো না আমার। এই নির্বান্ধব জীবনে একটু কথা বলার লোক নেই আমার একদম। পরক্ষণেই ফোন করে ফেললাম আমার সেই কলকাতার আমলকী গাছের চেনা বন্ধুকে। খুব বেশিদিন হয়নি এই বন্ধুত্ব আমাদের। এক ফোনেই সেই বন্ধু আমার ফোনে উত্তর দিলো। বললো দাদা বলো কি খবর। আমি বললাম মহিষঢাল যাচ্ছি দাদা সর্ষে ক্ষেতের ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে পড়েছি আমি রাস্তায়। সে বলল দাদা, ঘরে শুয়ে ছবি দেখি দাও আমায়। আমি ছবি দিলাম তাকে সে ছবি দেখে উত্তর দিলো বাহ ,দারুন সুন্দর। মনটা ভালো হয়ে গেলো আমার। তাহলে কেউ একজন তো ফোনে কথা বললো আমার সাথে উত্তর দিলো আমায় এই বন্ধুহীন জীবনে শীতের আলসেমির দুপুরে ঘুম ভেঙে উঠে।
এগিয়ে চললাম আবার সেই শীর্ণকায় কোপাই এর ধার ধরে ছোট্ট গ্রামে মহিষঢালে। তালতোড় এর জমিদার বাড়ী পার হয়ে প্রান্তিক থেকে কোপাই যাওয়ার রেল লাইনের নিচের পথ ধরে এগিয়ে চললাম সেই গ্রামের দিকে। আর দেখলাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই গ্রামের নামফলক। আর সেই নামফলকের সাথে তাল মিলিয়ে গোটা রাস্তা জুড়েই গরু মহিষের দল ঘরে ফিরছে তারা লাইন করে। সত্যিই তো নদীর ঢালু পথে সকাল হলেই গরু মহিষের বিচরণ ক্ষেত্র। আর সেই থেকেই তো এই জায়গার নাম হলো মহিষঢাল। লাঠি হাতে বৃদ্ধা আপন মনে এগিয়ে চলেছে ঘরের দিকে। আর সেই কোপাই ব্রিজের উপর চার পেয়েদের দুলকি চালে ঘরে ফেরা। কেমন যেনো উন্নয়নের রাস্তায় গতিও হঠাৎ করেই শ্লথ করে দিলো। ওদের দেখতে দেখতে, আর কোপাই নদীতে শেষ বেলায় কেমন জাল ফেলার ছবি তুলতে তুলতে আমি পৌঁছে গেলাম সেই গ্রামে।
গ্রামের রাস্তায় তখন বাঁশপাতার মিষ্টি গন্ধ ভুরভুর করছে। ঠিক যেনো মিঠে পানের পাতায় আমার দিদার সেই জর্দা কৌটো খুললে যে গন্ধ বের হতো একদম সেই গন্ধ।গরুর গায়ের গন্ধ আর বাঁশ বন এর ভিতর থেকে আসা একটি মিষ্টি গন্ধ গায়ে মেখে এগিয়ে চললাম আমি সেই মহিষঢাল বাঙালি পাড়ার দিকে ধীরে ধীরে সাইকেল না চালিয়ে পায়ে হেঁটে। আদিবাসী পাড়া পার হয়ে একে ওকে জিজ্ঞাসা করতে করতে। সেই মেঠো রাস্তায় শুকনো খড় এর ওপর কেমন দুটি কালো ছাগলের পথ আটকে খেলা করা। মাটির বাড়ীর ঘুঁটে দেওয়া দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মা মাটি মানুষের উজ্জ্বল প্রতীক। গ্রাম্য বৌ এর লাজুক চাওনি। আর গাছের নিচে পড়তে বসা দুই শিশুর আমায় অবাক চোখে দেখা।
বেশ ভালই লাগলো আমার। শীতের পড়ন্ত বিকেলের রোদ তখন সর্ষে ক্ষেতের ওপর থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়ে দূরে গাছের আড়ালে মুখ লুকোতে ব্যস্ত ত্রস্ত পায়ে। ওই গ্রামের কলে জল নিতে আসা লাজুক প্রকৃতির বউ এর মতই। না ঘরে ঘরে সরকারের জল পৌঁছে যায়নি এখনো এই গ্রামের সব বাড়ীতে। যদিও গ্রামের এক ছেলের জবাব পাইপ পড়েছে অনেক আগেই এই গ্রামে। জল এসে হাজির হয়নি উন্নয়নের গতির সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত গতিতে। বাহ দারুন সুন্দর তো। এগিয়ে গেলাম আরও কিছুটা গ্রামের ভেতরে আমি পায়ে হেঁটে।
গ্রামের ধারে রাস্তার পাশে আলপনা দেওয়া ছোট্ট জায়গায় ঠাকুরের থানে উল্টোনো ঘট আনমনে পড়ে আছে একা একাই কেমন করে যেন। জমির আলপথ ধরে ঘরে ফেরা পুরুষ নারীর দল সারাদিনের চাষের কাজ সেরে ঘরে ফিরছে তারা। গোটা গ্রাম জুড়েই তখন অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে। সেই মাটির গন্ধ মাখা জীবন নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম আমি এদিক ওদিক একা,একদম একাই।
সেই শুকনো খড়ের গাদায় তখন নরম রোদের আলতো ছোঁয়া। রং চটা মাটির বাড়ী, টিনের চাল, উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা ধানের মরাই, আলোহীন ঘর দুয়ার, দূরে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক,ঝি ঝি পোকার ডাক, আর সেই মিষ্টি গন্ধ মাখা অন্ধকার পথ ধরে হেঁটে বেড়ালাম আমি একা একাই।
শীতের সন্ধ্যায় তখন দূরে শিয়ালের মন কেমন করা হুক্কা হুয়া ডাক, সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বেলে উঠোনে দাঁড়িয়ে সেই ছাপা শাড়ি পরা লাজুক বউ এর প্রদীপ হাতে প্রনাম করা। আর সেই স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রং চটা মাটির ঘর, দুয়ার, আলপথ, সর্ষে ক্ষেতের হলুদ ফুলের মিষ্টি গন্ধ, সেই বাঁশ পাতার মিষ্টি মন কেমন করা গন্ধ, সেই মাটির উঠোনে আলপনা দেওয়া ধানের মড়াই এর গন্ধে ভরপুর এই গ্রাম। সেই গন্ধকে বুকে জড়িয়ে ঘরে ফেরার পথ ধরলাম আমি। অন্ধকার পথ পেরিয়ে উজ্জ্বল অলোকময় শহরে। যে শহরে বড্ড বেশি ভীড়। যে শহরে বড্ড বেশী হিসেব নিকেশ করে কথা বলা, চলা আর দ্রুত গতিতে বদলে যাওয়া।
মহিষঢালের গল্প - অভিজিৎ বসু।
চব্বিশ জানুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন