একটা ভেঙে পড়া বিবর্ণ বাড়ী। রং চটা বিবর্ণ কিছু স্মৃতি। কিছু চেনা পথ। কিছু চেনা মানুষ। আর দ্রুত বদলে যাওয়া একটা চেনা ছোট্ট মফঃস্বল শহর। আর সব কিছুর মাঝে লুকিয়ে আছে গভীর গোপন কিছু ভালোবাসার যন্ত্রণাময় অনুভূতির ধুকপুক অনুরণন। যে অনুভুতির কোনও শব্দ নেই। যে অনুভূতির অনুরণনের কোনও ভাষা নেই। যাকে আর চোখে দেখা যাবে না কোনওদিন। শুধুই বোবা দৃষ্টির আকর্ষণ নিয়ে বেঁচে থাকা।
শুধু এই নিস্তব্ধ বাড়ীর চারপাশে ছড়িয়ে আছে কিছু বোবা দৃষ্টি আর বোবা মুখের অব্যক্ত যন্ত্রনা। যে যন্ত্রণাকে বুকে নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছে বহুদিন বহু বছর এই বাড়িতে একা, একদম একাই। যে যন্ত্রণাকে বুকের মাঝে চেপে রেখেই ভালোবাসার এই বিবর্ণ রং হীন বাড়ী থেকে চলে যেতে হয়েছে একদিন চুপিসারে গুটি গুটি পায়ে। এই টালির ঘরের মায়া কাটিয়ে। এই আমগাছের বউলের গন্ধের মায়া কাটিয়ে, এই লাল আর সাদা জবার রেনুর গন্ধের মায়া কাটিয়ে, তুলসী তলার সন্ধ্যা পিদিম জ্বলার আলোর মায়া কাটিয়ে। লেবু পাতার মিষ্টি গন্ধের মায়া কাটিয়ে আর মাসের নির্দিষ্ট দিনের সেই সুমধুর কীর্তনের মায়া কাটিয়ে।
বাড়ির গায়ে নাম ফলকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই ফুটে আছে লেখা একটি নাম। যে নাম আজ একা, একদম একাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোটা দেওয়াল জুড়ে। এই শীতের নিঝুম সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা হিমেল বাতাস গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকা চুপটি করে। ঠিক যেনো দূরের পথ পানে চেয়ে থাকা। নির্নিমেষ সেই দৃষ্টি। নির্নিমেষ সেই দৃষ্টিপথে কেমন ভালোবাসার মায়া জড়ানো, রেশমী রুমাল বিছানো সেই পথ। যে এবড়ো খেবড়ো পথের চারপাশে কতো ভীড়। কত চেনা টুকরো মুখ এর হাসি, উচ্ছাস আরও কত কী। সত্যিই বেশ ভালো ছিল সেই সময়ের দিনগুলো।
রং চটা বিবর্ণ বাড়ীটাও কেমন গম গম করতো এক সময়। বাসনের আওয়াজ, দরজায় ঠকঠক শব্দ, সকাল হলেই ব্যস্ততা, রেডিওতে ভোরে ভাটিয়ালী গানের সুর, কাজের ব্যস্ততায় ভরা একটা জীবন। একটা গোটা ভরা সংসার। যে জীবনের অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসার স্পর্শ, নানা মানুষের আনাগোনা আর মানুষের কল্যাণে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়া চুপটি করে কাউকে কিছু না বলে। কেমন করে যে কেটে গেলো এতগুলো বছর কে জানে।
আজ বহুদিন পরে আমি সেই চেনা এবড়ো খেবড়ো পথ ধরে ছোটবেলার সেই বাড়ীতে পৌঁছে গেলাম একা, একদম একা। যে পথের ধারে কেউ অপেক্ষা করেনি আর। যে পথের শেষে ভালোবাসার স্পর্শ ছুঁয়ে যায়নি আমায়। সন্ধ্যার একফালি চাঁদ কেমন দূর থেকে আলগোছে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে আমার রাস্তার দিকে। আর মনে মনে ভেবেছে যাক এবড়ো খেবড়ো পথ আর খানাখন্দ পাড় করে এসেছে অনেক কষ্টে এটাই অনেক বড় ব্যাপার।
নিস্তব্ধ বাড়ীর চারপাশে কেমন যেনো একটা মায়ার চাদরে মোড়া চেনা আবহাওয়া। এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে খুঁজে ফেরা সেই মায়ার চাদরে মোড়া ভালোবাসার মানুষটাকে। না, কিছু রং চটা বিবর্ণ স্মৃতি, কিছু কথা, কিছু অভিমান, কিছু যন্ত্রণা, কিছু আশা, কিছু ভালোবাসা, কিছু বাকি অব্যক্ত কথা দেওয়ালে হেলান দিয়ে কেমন করে যেনো আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে। ভেঙে পড়া দেওয়াল, ঘরের বন্ধ জানলা, ফাটা দরজার চৌকাঠে যেনো থমকে গেছে আমার স্মৃতির সরু গলিপথ আচমকাই হঠাৎ করে।
যে গলিপথ ধরে একদিন চৌকাঠ পেরিয়ে কেমন একছুট্টে ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তাম আমি সেই ছোট্টবেলায়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে নেচে বেড়াতাম মাঠের মাঝে দু হাত তুলে। বৃষ্টিতে ভিজতাম। আর সন্ধ্যা হলেই কেমন যেনো ভয়ে ভয়ে কচুপাতা মাথায় দিয়ে ভিজে কাকচান করে ঘরে ফিরতাম চুপি চুপি। এই শীতের দুপুরে পুকুরের কালো পানিতে ছিপ ফেলে বসে থাকতাম কৈ মাছের আশায়। আর সেই পুকুরের ঢাল বেয়ে পানের বোরোজ ছেড়ে একদৌড়ে চলে যাওয়া হাতে কেটলি নিয়ে জল আনতে বড়ো পিচের রাস্তায়। সেই রাস্তার কল এখন ঘরের একদম অন্দরে।
সেই মাটির ঘরের সোঁদা গন্ধ, মাটির ঘরের বাইরে শামুকের পিচ্ছিল পথ ধরে শব্দহীন ভাবে এগিয়ে যাওয়া। আর নিঃশব্দে পুকুরের ধার ধরে এগিয়ে আসা চন্দ্রবোড়া বা দাঁড়াশ সাপের দল। যদিও তারা এই হাল আমলের মানুষের থেকে অনেক কম ক্ষতিকর ছিল তারা সেই সময়। পুকুরের কালো জল বেয়ে শীতের দুপুরে সেই হলুদ তেল চকচকে গায়ে সোনা রোদ মেখে গোসাপের সাঁতার কাটা দেখে বড়ো হওয়া আমার।
আর আজ কেমন যেনো সেই স্মৃতির ঢালু পথ ধরে এগিয়ে চলা। সেই বোবা দৃষ্টির খোঁজে, সেই মায়া জড়ানো ভালোবাসায় মোড়া রেশমী পথে হেঁটে চলা একা, একদম একা। যে পথের ধারে শুধুই দেওয়ালে নাম ফলকে নিষ্প্রভ হয়ে আটকে থাকা আমার মায়া জড়ানো ভালোবাসাময় একটা শব্দহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন, উচ্ছাসহীন, স্থবির হয়ে যাওয়া একটি জীবন। যে জীবনের আর কোনও ভাবেই সন্ধান পাবো না আমি কোনোদিন।
দ্বিতীয়ার চাঁদের নরম আলোয় বিবর্ণ দেওয়াল জুড়ে শুধুই আমার ভালোবাসার শব্দহীন শীতার্ত এক বাঙময় অনুভূতি। যাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে হবে আমায় এই বাকি জীবন। বিবর্ণ রং হীন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি। শুধুই আমার এলোমেলো এলেবেলে জীবন নিয়ে। যে জীবনে চারিপাশে ছড়িয়ে আছে শুধুই আমার ভালোবাসার শব্দহীন স্পর্শ।
বিবর্ণ বাড়ী ও ভালোবাসার স্পর্শ - অভিজিৎ বসু।
সতেরো জানুয়ারী, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন