কিছু কিছু ভেঙে পড়া বাড়ী আর সেই বাড়ির বিবর্ণ স্মৃতির উত্তাপ গায়ে মেখে ঘুরে বেড়াতে বেশ ভালো লাগে আমার। এই সব বাড়ির ৪০০ বছরের বিস্মৃত ইতিহাস আর তার নীরব অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালই লাগে আমার। তাই শিবরাত্রির দিন বেরিয়ে পড়লাম আমি গাড়ি নিয়ে বোলপুর থেকে। সেই বিখ্যাত ইলামবাজার এর জঙ্গল পেরিয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার কালিকাপুর গ্রামে। সেই বিখ্যাত কালিকাপুর এর মৌখিরার রাজবাড়ি দেখতে। যে বাড়িতে একসময় বহু পুরোনো দিনে সিনেমার শুটিং হয়েছে। কলকাতা থেকে এই বাড়ির দূরত্ব প্রায় ১৭৫ কিলোমিটার। বোলপুর থেকে মেরে কেটে ত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার হবে প্রায়।
এই বিখ্যাত বাড়িতেই মৃণাল সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, সন্দীপ রায়, অনিক দত্ত, বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায়, ও ধ্রুব ব্যানার্জী এই বাড়িকে শুটিং এর স্থান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই কালিকাপুর এর বাড়িতেই মৃণাল সেনের খন্ডার ছবির একটি দৃশ্য আছে। যেখানে অভিনয় করেন নাসিরউদ্দিন শাহ ও শাবানা আজমি। এছাড়াও বহুরূপী, রং মিলান্তি, তাসের দেশ, বাস্তুসাপ, গয়নার বাক্স, কাজলের মা, এই সব শুটিং হয়েছে এই বাড়িতেই। যে বাড়ীর বিবর্ণ দেওয়ালে শুধুই নানা গল্প আর ইতিহাস আজও বেঁচে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
সেই ইতিহাস এর বাড়িতেই ঘুরে বেড়ানো। সেই বাড়ীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে পুরোনো দিনের স্মৃতি। যা দেখে মন ভরে যায় আমার। যে বাড়ী প্রায় ৪০০ বছর আগে নির্মিত হয় এই বাড়ির কাঠামো। এক সময় ছোট্ট জঙ্গল ঘেরা গ্রাম ছিল এই কালিকাপুর। বাংলার অন্য গ্রামের মতই কৃষিনির্ভর গ্রাম এটি। যেখানে মূলত কৃষকরা বাস করেন। স্থানীয় ইতিহাস অনুসারে ৩৫০ বছরের বেশি সময় আগে পরমানন্দ রায় ও তার পরিবার এবং সাত ছেলেকে নিয়ে কালিকাপুর চলে আসেন। বিশাল জঙ্গল তাঁদের ছিল সেই সময় তিনি জমিদারি পান বর্ধমান মহারাজার কাছ থেকে। এই বাড়ির ইতিহাসে পাওয়া যায় যে এই বাড়ির সম্পত্তি ছিল রাণীগঞ্জের কয়লাখনি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
কালিকাপুর এ বসতি স্থাপন করতে এসে পরমানন্দ রায় তাঁর সাত ছেলের জন্য সাতটি ভবন তৈরি করেন। তাঁর বড় ছেলে কৈলাশপতি বাবার থেকে দায়িত্ব ভার নেন এই সময়ে রায় পরিবার বেশ সমৃদ্ধ হয় নানা ভাবে আর্থিক উন্নয়ন হয় এই পরিবারের। এই বাড়ীতে আছে দুর্গা, শিব আর রাধাবিনোদের মন্দির। এই বহু পুরোনো শিব মন্দিরের অসাধারণ স্থাপত্য সাথে টেরাকোটার শিল্পের নিদর্শন হিসেবে এই মন্দিরটি দাঁড়িয়ে আছে যা দেখে বেশ ভালো লাগলো। কিন্তু এই মন্দির একমাত্র বর্তমান যিনি পুরোহিত তিনি এই মন্দিরের দেখভাল করেন।
বর্ধমানের রাজার সাথে এই রায় পরিবারের বেশ সুসম্পর্ক ছিল। এই গ্রামে ব্রিটিশদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার জন্য তাঁরা ব্রিটিশদের নীল চাষের অনুমতিও দিয়েছিলেন এই রায় পরিবারের পূর্বপুরুষরা তেমন জানা যায়। এই বাড়ী ও মন্দির থেকে একটু দূরে নীলকুঠি আছে বলেও জানা যায়। প্রায় কুড়ি বিঘা জমি জুড়ে এই ভবন তৈরি হয়। গোটা ভবনটি একটি দীর্ঘ করিডোর দিয়ে একে অপরের সাথে সংযুক্ত। তিনতলার এই ভবনে কিন্তু প্রায় পাঁচ তলার বাড়ির মতই উঁচু। এই বাড়ির মধ্য রয়েছে দুর্গা দালান, রয়েছে বাদাম মন্দির। একটি অনন্য জ্যামিতিক নকশা দিয়ে তৈরি এই বাড়ী। যা ভূমিকম্প ও বন্যা সহ্য করার জন্য বিশেষ উপায়ে প্রাকৃতিক আঠালো ইঁট দিয়ে তৈরি হয়। যা দুর্দান্ত শক্তি তৈরি করে।
৪০০ বছর আগের তৈরি এই কালিকাপুর রাজবাড়ির দেওয়াল মজবুত করার জন্য টেরাকটার ইঁট ব্যবহার করা হতো। যে ইঁট তৈরি হতো স্থানীয় পুকুরের পলিমাটি, নির্দিষ্ট গাছের পাতা আর কিছু ভেষজ মিশিয়ে। যার জন্য একশো বছর ধরে এই দেওয়াল অক্ষুণ্ন থাকতো। দেওয়ালে ও ছাদে সুন্দর ফুলের শোভা দেখা যায়। বাড়ির সামনের অংশে নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানালেন বর্তমান আট পুরুষের বংশধর মহীতোষ রায়। তাঁর মতে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে সামনের অংশ কাজ করতে। তাঁরা চেষ্টা করছেন কিছু কিছু ভাবে সংরক্ষণ করে এই পুরোনো বাড়িকে রক্ষা করতে। যে বাড়িকে একসময় সরকার নিতে চেয়েছিল। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে করতে চেয়ে সেখানে এই বাড়ির বিভিন্ন অংশকে সারিয়ে টুরিস্ট এনে তাদের থাকার ব্যবস্থা করবেন লিজের মাধ্যমে। কিন্তু বাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে আমরা সেটা করিনি বলে জানান এক সদস্য মহীতোষ রায়।
এই বাড়ী জমজমাট হয়ে ওঠে দুর্গা পুজোর সময়। অতীতের রীতি মেনেই পূজো হয়ে আসছে আজও। নিত্য পূজা করেন শিবমন্দিরে কূল পুরোহিত এর বর্তমান বংশধর যিনি আছেন তিনি। বর্ধমান রাজার দেওয়ান ছিলেন এই পরমানন্দ রায়। রাজার সুনজরে পড়ায় তিনি এই কাকসার এক বড়ো এলাকার জমিদারিত্ব পান সেই সময়। সেই বাড়ি আজও এই পুরোনো দিনের ইতিহাসকে বুকে আগলে আজ দাঁড়িয়ে আছে। সাতজন ভাই একসাথে এই বাড়ির দুর্গাপুজোয় পূজো করতেন বলে এই পূজো সাত ভাইয়ের পূজো নামেই পরিচিত হয়ে গেছে।
যে পূজো করেন বর্তমানে পিকলু বলে একজন পুরোহিত। অতীতের রীতি মেনে এই পূজো হয়। অনেকে এই পূজো দূর দূরান্ত থেকে দেখতে আসেন। পূজোর সময় গমগম করে ওঠে গোটা এলাকা। দূর থেকে পরিবারের সদস্য যাঁরা আছেন তারাও ছুটে আসেন। শান্ত নির্জন এই এলাকায় একদিন ঘুরে এলে খারাপ লাগবে না। প্রায় চারশো বছরের ইতিহাসকে বুকে আগলে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়ি।
যার ভেঙে পড়া দেওয়ালে কত গল্প ইতিহাস জড়িয়ে আছে। শুধুই ব্যবসা করার জন্য এই পরিবারের বর্তমান সদস্যরা নিজেদের আর্থিক লাভের জন্য এই বাড়িকে সরকারের অধীনে ঠিকাদার এর হাতে তুলে দেননি। শুধুই নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখবেন বলে গ্রামের এই শান্ত পরিবেশকে ধরে রাখবেন বলে সেকথাই জানান রায় পরিবারের এই সদস্য। যিনি জয়পুর থেকে মাঝে মাঝেই এসে এই বাড়িতে থাকেন কাজের দেখভাল করেন এই বাড়ীর ট্রাস্টির সদস্য হিসেবে। এই কালিকপুর এর মৌখিরা গ্রাম আজও এই একভাবেই পুরোনো দিনের স্মৃতিকে আগলে ধরে বেঁচে আছে। ঘরের কাছে এই পূর্ব বর্ধমানের এই জায়গা ঘুরে এলে ভালোই লাগবে। গ্রাম দর্শনে কালিকাপুর আর মৌখিরা কিন্তু ভালো লাগবে।
কালিকাপুর এর রাজবাড়ি দর্শন - অভিজিৎ বসু।
আটাশ ফেব্রুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
দারুণ।
উত্তরমুছুন