বীরভূমের ইলামবাজার ব্লকের বেশ কিছু এলাকা। বসন্তের আকাশে ঢলে পড়া সূর্য, লাল পলাশের হাসি মেখে কেমন অস্তাচলে যায় আপনমনে। সূর্যের নরম আলো পলাশের গায়ে মেখে লুটোপুটি খায় এদিক ওদিক। আর সেটা দেখে সেই ফিঙের আনন্দের নাচন বোগেনভেলিয়ার ডালে ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে চুপটি করে। বেশ এই লাল মাটির রুখুসুখু রাস্তা, দুরে দিকচক্রবালে ঢলে পড়া আকাশ, পাতা ঝরার সময় এসে গেছে চারিদিকে।
বাতাসে শীতের কামড় নেই আর। প্রকৃতি বুঝিয়ে দিচ্ছে সেকথা আমাদের। তার মাঝেই ঘুরে বেড়ানো দ্বারান্দা গ্রামে। ঘুরে বেড়ানো নানা জঙ্গলে ঘেরা ছোটো ছোটো গ্রামে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে মসৃণ রাস্তা ধরে। শাল, পিয়াল, সোনাঝুড়ি আর নানা গাছের সারি দিয়ে ঘেরা এই জঙ্গল এই বনাঞ্চল। যে বনকে বাঁচাতে এলাকার যুবকরা সব এক হয়ে একজোট হয়ে দল বেঁধেছে একসাথেই। যাতে বন জঙ্গল নষ্ট না হয় কিছুতেই। যাতে কাঠ পাচার এর জন্য জঙ্গল এর গাছ কাটা না হয়। যাতে কোনোভাবেই এইসব এলাকায় বহুতল আবাসন প্রকল্প না হয়।
সে কথাই বলছিলেন সদা প্রাণবন্ত হাস্যময় দেবাশীষ বাবু। এই এলাকার বাসিন্দা যিনি দীর্ঘদিন ধরেই জঙ্গল কে ভালোবেসে আর এই এলাকায় ঘর বেঁধে কাটিয়ে দিলেন তিনি এই জায়গায় সেই নদীয়া থেকে এসে। দেবাশীষ বাবুর গল্প অন্য একদিন অন্য সময় হবে নিশ্চয়ই। আজ শুধু এই জঙ্গল এর কথা। এই এলাকার মানুষের কথা। এই সব মানুষদের জীবনের কথা আর নানা সংগ্রামের কথা। যে শান্ত শীতল সুন্দর জীবন এর মাঝে আছে দুঃখের, কষ্টের গভীর গোপন জীবন এর কথা। সেই বড়ো রাস্তার পাশে মা মেয়ে আর ছেলের দোকান চালিয়ে সংসার জীবনের কথা। সেই দেবাশীষ দার সুন্দর ছোটো একচিলতে ঘরে বসে স্বপ্ন দেখা ভালোবাসার সংসারের কথা। সত্যিই কত যে জীবন এই জঙ্গলে লুকিয়ে আছে কে জানে।
ইলামবাজার সড়ক ও অজয় নদীর তীরের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় একটি বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। তাঁত কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকার সুবিধাও এর ছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এই ইলামবাজারে একটি কারখানা ছিল। ১৭৮০-এর দশকে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও ইলামবাজার এলাকায় অভিযান চালায়, যার ফলে তাঁতিদের সুবিধার জন্য দাম বেড়ে যায়। ১৭৮৬ সালে ইংরেজরা বীরভূম জেলার সরাসরি প্রশাসন গ্রহণ করে।
১৭৭০ সালের মহাবঙ্গীয় দুর্ভিক্ষে বীরভূম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অনেক গ্রাম সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, এমনকি বড় শহরগুলিতেও, তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি পরিবার মারা গিয়েছিল। ১৭৮৯ সালের জুনে কৃষক বিদ্রোহের সময়, ইলামবাজারকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, যদিও এটি পুনরুদ্ধার করে এবং উৎপাদন ও বাণিজ্যের জন্য একটি আকর্ষণ হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ইলামবাজারের জন এরস্কাইন ছিলেন এই অঞ্চলের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় চিনি প্রস্তুতকারক এবং রপ্তানিকারক। ইলামবাজার একসময় নীল চাষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল, যার চিহ্ন এখনও পাওয়া যায়।
এই চৌপাহাড়ির জঙ্গলের মোট এলাকা প্রায় ১৩.৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। ল্যাটেরাইট মাটির রাস্তা। সেই জায়গায় ঘুরে বেড়াতে বেশ ভালই লাগে। চারিদিকে রিসর্ট আর হোমস্টের ছড়াছড়ি এই এলাকায়। এই কলকাতার ভীড় ছেড়ে শহর ছেড়ে এই জঙ্গলের ফাঁকা জায়গায় এসে দু দণ্ড বিশ্রাম নেওয়ার জন্য অনেকেই এই জায়গায় বসতি স্থাপন করতে আসছেন। যার জন্যে দ্রুত হারে বাড়ছে জমির দাম। যে জমির দাম ওঠা নামা নিয়ে কিছুটা হলেও অসন্তোষ আছে। তবে জঙ্গলের ভেতর এই বহিরাগত মানুষজন বসবাস করায় ভীড় বাড়ছে এলাকায়। কিছুটা হলেও পরিবেশ আক্রান্ত হচ্ছে। তবুও সবকিছুর মাঝে এই জঙ্গল আজও মানুষের কাছে প্রিয়। এই জঙ্গলকে ঘিরেই মানুষের জীবন এর বাঁচার জন্য রুজি রোজগার হচ্ছে। পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলে অবশ্যই আরও কিছু উন্নতি করা সম্ভব এই এলাকায়।
ইলামবাজার এর জঙ্গলে - অভিজিৎ বসু।
আঠাশ ফেব্রুয়ারী দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য মেয়ের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন